X
বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪
২০ আষাঢ় ১৪৩১

শিক্ষক বদলিতে যত ভোগান্তি

এস এস আববাস
০৫ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:২৮আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০১৯, ২৩:২৬

প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতি - ১

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলিতে যে প্রক্রিয়া মানা হয়, আর কোনও সরকারি কাজে এমন পদ্ধতি দেখা যায় না। বদলি হওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রথমেই ছুটি নিতে হয়, তারপর সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর টেবিলে টেবিলে টাকা গুনতে হয়, তারপর দীর্ঘ অপেক্ষার পালা। এতে করে শিক্ষক এবং তার পরিবার যেমন ভোগান্তির শিকার হন, তেমনি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের সূত্র ও ভুক্তভোগী শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

চট্টগ্রামের একজন শিক্ষকের স্বামী শামসুদ্দিন ইলিয়াস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্ত্রীর বদলির জন্য এক অফিসে বার বার যেতে হয়েছে। একটি ফাইল এক টেবিলে তিনবার পর্যন্ত নিতে হয়। এমন প্রক্রিয়ায় যে ভোগান্তি হয়েছে, তা অন্য কোনও কাজে হয় না। শুধু তাই নয়, শিক্ষক বদলির এই সিস্টেমে শিক্ষা প্রশাসনের কিছু অসৎ কর্মকর্তার আয় বাড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক বদলির ক্ষেত্রে মাঠপর্যায় থেকে অধিদফতর পর্যন্ত সর্বত্র একই চিত্র। আধুনিক যুগে এই পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেন, শিক্ষকদের এই জিম্মি অবস্থা থেকে বাঁচাতে একটা কিছু করা দরকার। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর থেকে বার বার বলা হয়, শিক্ষকদের সুবিধামতো বদলি করতে হবে। অথচ বদলি প্রক্রিয়ার শুরুটাই হয় ভোগান্তি দিয়ে।

বিদ্যমান বদলি পদ্ধতি

মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উপজেলা শিক্ষা অফিসার থেকে শুরু করে মহাপরিচালক বরাবর নির্দিষ্ট ফরমেটে কাগজে লিখে আবেদন করেন। একই উপজেলার মধ্যে এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে কেউ বদলি হতে চাইলে সেটা করেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার। একই জেলার মধ্যে বদলির ক্ষেত্রে বদলি করেন জেলা শিক্ষা অফিসার। এক বিভাগের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জেলার বদলির ক্ষেত্রে বদলি করেন বিভাগীয় উপরিচালক। এছাড়া, এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে এবং মফস্বল থেকে মহানগরে বদলি করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। আবার রাজধানীর ক্ষেত্রে অধিদফতর শিক্ষকদের বদলি করলেও মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। এসব বদলিতে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হয় শিক্ষকদের। দেখা গেছে, এসব বদলির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় না। ফলে প্রতিটি ধাপে শিক্ষকরা যেমন হয়রানির শিকার হন, তেমনি একশ্রেণির অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলির আবেদনকারীদের কাছ থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নেন।
বিদ্যমান এই ব্যবস্থায় বদলির আবেদনের পর শিক্ষকরা ধরনা দেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অফিসে। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বা ক্লাস বন্ধ করে শিক্ষকদেরকে দিনের পর দিন, কখনও মাসের পর মাস উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কার্যালয়, উপপরিচালকের কার্যালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ধরনা দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট এই কার্যালয়গুলো শিক্ষকদের আবেদন কতদিনে বিবেচনায় নেবে, তার জন্য শিক্ষকরা একপর্যায়ে নানা মাধ্যমে তদবির শুরু করেন।

বিদ্যমান বদলিতে জটিলতা ও হয়রানি
ভুক্তভোগী শিক্ষকদের অভিযোগ, উপজেলা ও জেলাপর্যায়ের বদলির তুলনায় মেট্রোপলিটন সিটি ও এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে বদলির ক্ষেত্রে হয়রানির ঘটনা সবচেয়ে বেশি। বদলির অনুমোদন করাতে অনেক ধাপে টাকা দিতে হয়। জানা গেছে, মেট্রোপলিটন সিটি ও এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে বদলির ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আবেদন করতে হয় মহাপরিচালক বরাবর। এক্ষেত্রে তাদেরকে বিভিন্ন টেবিলে ধরনা দিতে হয়। এক কর্মকর্তার টেবিলে ন্যূনতম তিনবার নথি চালাচালি করতে হয়। এই প্রক্রিয়া মেনেই বিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে দিনের পর দিন টেবিলে টেবিলে দৌড়ে বেড়ান শিক্ষকরা। সংশ্লিষ্ট অফিসের বিভিন্ন স্তরে টাকা দিতেও বাধ্য হন তারা। এতে করে কেবল যে শিক্ষকরাই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তা-ই নয়, শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থোকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কোনও শিক্ষক যদি এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে, অথবা রাজধানীতে শূন্য পদে প্রাপ্যতা অনুযায়ী বদলি হতে চান, তবে তার আবেদনপত্রে প্রধান শিক্ষক, উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সুপারিশ নিয়ে জেলা শিক্ষা অফিসে জমা দিতে হয়। জেলা শিক্ষা অফিসার আবেদনের ফাইলটি সুপারিশসহ বিভাগীয় অফিসে পাঠান। এরপর বিভাগীয় অফিস থেকে আবেদনটি অধিদফতরে পাঠানো হয়। এ পর্যায়ে শূন্যপদ নিশ্চিত করে ওই পদের বিপরীতে বদলির অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
জানা যায়, মহাপরিচালক ফাইলটি ‘সিন’ করে পরিচালকের (পলিসি ও অপারেশন) টেবিলে পাঠান। সেখান থেকে ফাইলটি ‘সিন’ হয়ে চলে যায় উপপরিচালকের (বিদ্যালয়) কাছে। উপরিচালক ‘সিন’ করে পাঠান সহকারী পরিচালকের (পলিসি) কাছে। সহকারী পরিচালক পাঠিয়ে দেন একজন শিক্ষা অফিসারের কাছে। আবেদনকারী শিক্ষক যে জেলায় বদলি হতে চান, সেই জেলার সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শূন্য পদে বদলির জন্য শূন্য পদ চাওয়া হবে কি না, তার অনুমোদন চেয়ে ওই শিক্ষা অফিসার এবার ফাইল পাঠিয়ে দেন সহকারী পরিচালকের (পলিসি) কাছে। তিনি ফাইলটি ফরওয়ার্ড করে দেন উপপরিচালক (বিদ্যালয়) এর কাছে। উপপরিচালক ওই ফাইলটি পাঠিয়ে দেন পরিচালকের (পলিসি ও অপারেশন) কাছে। পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) শূন্য পদ চাওয়ার অনুমোদন দিয়ে সহকারী পরিচালকের (পলিসি) কাছে ফাইলটি ফরওয়ার্ড করেন। সহকারী পরিচালক (পলিসি) ফাইলে অনুমোদন দিয়ে জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে চিঠি পাঠান। জেলা শিক্ষা অফিসার সংশ্লিষ্ট উপজেলাকে চিঠি দিয়ে শূন্য পদের অনুমোদন চান। উপজেলা শিক্ষা অফিসার শূন্যপদ নিশ্চিত করে বদলি করা যেতে পারে মর্মে আবার চিঠি দেন জেলা শিক্ষা অফিসারকে। জেলা শিক্ষা অফিসার উপজেলা শিক্ষা অফিসারের চিঠিসহ মহাপরিচালকের দফতরে সরাসরি ফাইলটি পাঠিয়ে দেন। এরপর বদলি ও পদায়ন করার আদেশ জারির অনুমোদন হলে পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) আদেশ জারি করেন।

একদিকে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তার ওপর শিক্ষকরা যখন-তখন বদলি হতে পারেন না। নিয়মানুযায়ী, বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) শিক্ষকদের বদলি প্রক্রিয়া চলে। এবছর বদলির শেষ দিন ছিল গত ৩১ মার্চ। দেখা গেছে, শেষদিন পর্যন্ত কেবল রাজধানীতে বদলি চেয়ে ২০০টি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষক।
নারায়ণগঞ্জের একজন নারী শিক্ষকের স্বামী জাহাঙ্গীর এবং চট্টগ্রামের একজন নারী শিক্ষকের স্বামী মো. আকাশ দাবি করেন, বদলির প্রক্রিয়ার শুরু থেকে বিভিন্ন ধাপে টাকা না দিলে সহজে সুপারিশ মেলে না, ফাইল নড়ে না, এমনকি ফাইল গায়েবও হয়ে যায়। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেন অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. এএফএম মঞ্জুর কাদির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে কোনও দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

/এফএস/ এপিএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভারত সরকারের জন্য বাসে করে আম পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার
ভারত সরকারের জন্য বাসে করে আম পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার
গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে না: প্রতিমন্ত্রী
গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে না: প্রতিমন্ত্রী
বিশ্বের শীর্ষ ৫০টি সিফুডের তালিকায় বাঙ্গালি চিংড়ি মালাইকারি
বিশ্বের শীর্ষ ৫০টি সিফুডের তালিকায় বাঙ্গালি চিংড়ি মালাইকারি
মতিউরের ৪ ফ্ল্যাট ও ৮৬৬ শতাংশ জমি জব্দের নির্দেশ
মতিউরের ৪ ফ্ল্যাট ও ৮৬৬ শতাংশ জমি জব্দের নির্দেশ
সর্বাধিক পঠিত
ভিটামিন ডি কমে গেলে যে ৭ লক্ষণ প্রকাশ পায়
ভিটামিন ডি কমে গেলে যে ৭ লক্ষণ প্রকাশ পায়
আদালতে সাক্ষীরা জানালেন, তারা কিছু ‘জানেন না’ এবং ‘দেখেননি’
আলোচিত সাব্বির হত্যাকাণ্ডআদালতে সাক্ষীরা জানালেন, তারা কিছু ‘জানেন না’ এবং ‘দেখেননি’
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ, এমপির গাড়িও যেতে দেননি শিক্ষার্থীরা
কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ, এমপির গাড়িও যেতে দেননি শিক্ষার্থীরা
সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বয়স বাড়ানো নিয়ে যা বললেন মন্ত্রী
সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বয়স বাড়ানো নিয়ে যা বললেন মন্ত্রী
প্রেমের টানে বাংলাদেশে এসে বিপাকে পড়া তরুণীকে নিজ দেশে পাঠাতে পতাকা বৈঠক
প্রেমের টানে বাংলাদেশে এসে বিপাকে পড়া তরুণীকে নিজ দেশে পাঠাতে পতাকা বৈঠক