বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার উদ্যোগে প্রকাশিত ‘একলাখ মুফতি, উলামা ও ইমামের দস্তখতযুক্ত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী মানবকল্যাণে শান্তির ফতোয়া’র উদ্যোক্তাদের নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে কওমিপন্থী আলেম ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভেতর। তাদের কেউ কেউ বলছেন, এ সময়ে জঙ্গিবাদবিরোধী ফতোয়া সামাজিকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে পুরোপুরি ‘আদর্শিক’ মিল না থাকলেও ফতোয়া প্রকাশের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের বেশির ভাগ আলেম।
বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান আল্লামা আশরাফ আলী বলেন, লাখো আলেমের ফতোয়ায় আমি স্বাক্ষর করেছি। এটা আমিও মানি। ইসলাম কোনও হত্যাকেই সমর্থন করে না।
উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেননি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নির্বাহী সভাপতি মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাছ। তিনি বলেন, আমি ফতোয়ার শিরোনামে সংশোধন আনতে বলেছিলাম। কিন্তু পরে উদ্যোক্তারা যোগাযোগ করেননি। তবে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। মূল বিষয়ের সঙ্গে আমি একমত। এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই। তিনি আরও বলেন, এই ফতোয়ায় শুধু একটি অংশকে সামনে আনা হয়েছে। আইন হাতে তুলে নিয়ে আসামিকে মেরে ফেলাও ইসলাম সমর্থন করে না। এ বিষয়টিও আসা দরকার ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অপরাধপ্রবণ হয়েছে, এটিও অপরাধ। এটাও থাকা দরকার ছিল।
জানা গেছে, ফতোয়া সংগ্রাহক কমিটির আহ্বায়ক আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। রাজনৈতিকভাবে তার সঙ্গে বিবাদ থাকায় অনেক দল ও আলেম স্বাক্ষর করেননি। যদিও মাওলানা মাসঊদ মনে করেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়ায় কোনও আলেমই বিরোধিতা করেননি। অন্যান্য বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও এ নিয়ে একসঙ্গে কাজ করাই মহৎ বলে মনে করেন শোলাকিয়া ঈদগাহের এই খতিব।
গত শনিবার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লাখো আলেমের শান্তির ফতোয়া প্রকাশের আগে জামায়াত-শিবির ও তাদের প্রভাবাধীন কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের নেতাদের মধ্যে সমালোচনা তৈরি হয়।
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লাখো আলেমের ফতোয়া কার্যক্রমের নিয়ে সমালোচনা করেন বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, উনার সঙ্গে আমার কোনও লেনদেন নেই। উনার কেমন জনসাপোর্ট আছে, সেটা দেখলেই বুঝা যাবে ফতোয়ার প্রভাব কেমন হবে।
ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেননি লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া ও বড় কাটারা মাদ্রাসার আলেমরা। এই দুটি মাদ্রাসা ইসলামী ঐক্যজোটের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। ইসলাম কখনোই জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। স্বাক্ষর না করার বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
শনিবার প্রকাশিত ফতোয়ায় সর্বসম্মতভাবে এক লাখ আলেম ও মুফতিরা ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ ও আত্মঘাতী হামলাকে হারাম বলে আখ্যা দিয়েছেন। উদ্যোক্তারা আশা করেছেন, এই ফতোয়া প্রকাশিত হলে সন্ত্রাস পুরোপুরি ঠেকানো গেলেও বহুলাংশে হ্রাস পাবে এবং সন্ত্রাসের মদদদাতারা হতোদ্যম হবে। পুরুষ ও নারী মিলিয়ে মোট ১ লাখ ১ হাজার ৮৫০ জন আলেম ও মুফতির স্বাক্ষর করেছেন ওই উদ্যোগে। এর মধ্যে ৯২ হাজার ৫৩০ পুরুষ আলেম-মুফতি এবং ৯ হাজার ৩২০ জন নারী আলেম-মুফতি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলেম হচ্ছেন, হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, শায়খুল হাদিস আল্লামা আশরাফ আলী, মুফতি আবদুল হালিম বোখারী, মুফতি মনসুরুল হক, আল্লামা সুলতান যওক নদভী, আল্লামা আবদুর রহমান হাফেজ্জী অন্যতম।
এদিকে ফতোয়া প্রকাশকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা।
ইসলামী ছাত্র মজলিসের সাবেক সভাপতি মাওলানা রুহুল আমিন সাইমুম সাদী লিখেছেন, ইসলামের নামে যেমন জঙ্গি আছে তেমনি সেকুলারিজমের নামেও জঙ্গি আছে। সেক্যুলার নাম পরিচয় বহন করে যারা ইসলামি জীবনবিধান পালন করার অপরাধে মানুষকে মেরে ফেলে তাদের উপাধি কী হবে? সেক্যুলার জঙ্গি? সেক্যুলার সন্ত্রাসী? কোনটা? ফরীদ উদ্দিন মাসউদ সাহেব এক লক্ষ মুফতির স্বাক্ষর সংবলিত ফতোয়া প্রকাশ করেছেন ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেক্যুলারিজমের আড়ালে যারা জঙ্গিবাদের চাষবাস করছে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ফতোয়া কি আসবে ফরীদ উদ্দিন মাসউদ সাহেবের কাছ থেকে?
সাইমুম সাদী আরও লিখেন, শাহ আবদুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলভীর (রহ.) ঐতিহাসিক ফতোয়ার মতো কেউ কি সেই সাহসের পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারবেন? এই সময়টা খুবই নিষ্ফলা এবং আমরা সেই নিষ্ফলা জমির কৃষক।
তবে মাওলানা আনোয়ার আবদুল্লাহ লিখেছেন, এমন কি কেউ আছেন এই সাহসী কাজটি করবেন। তিনি (মাওলানা মাসঊদ) তো দিকভ্রান্ত তরুণদের চেতনা জাগ্রত করতে এই কাজটি করেছেন। অন্যরা বাকি কাজগুলো করতে পারেন।
আরও পড়তে পারেন: অভিজিৎ হত্যায় সন্দেহভাজন হাদি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত
/এমএনএইচ/