সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নতুন শুল্কনীতির কারণে সম্ভাব্য বহুমুখী সংকট মোকাবিলায় নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও এ লক্ষ্যে কাজ করছে। সরকারের তরফে তৈরি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাও।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ওপর এপ্রিল মাসের শুরুতে বিভিন্নহারে শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের অনুরোধের প্রেক্ষিতে এবং আলোচনা করার জন্য চীন ব্যতীত সংশ্লিষ্ট দেশের ওপর আরোপিত শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন নতুন এই শুল্কনীতির কারণে সৃষ্ট সমস্যা দূর করতে বর্তমানে ওয়াশিংটন ও ঢাকার মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েকদফা বৈঠক হয়েছে। সর্বশেষ ২৩ এপ্রিল বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। ওই বৈঠকে বাণিজ্যের অসমতা কমিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রস্তাবনা পাঠানোর পর আবারও মার্কিনীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৯০ দিনের যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেটির মধ্যে আমরা আলোচনা সম্পন্ন করতে চাই। এজন্য আমরা সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’
অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মার্কিনীদের আলোচনার বিষয়ে তিনি জানান, ইতোমধ্যে ভারত একটি সমঝোতা প্রায় চূড়ান্ত করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া তাদের প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে। এছাড়া জাপান তাদের আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রস্তাবনা
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য প্রায় ৮৫০ কোটি ডলারের মতো। এর মধ্যে বাংলাদেশের রফতানি ৬০০ কোটি ডলারের বেশি এবং যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি ২২০ কোটি ডলারের মতো। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য সুবিধা বেশি ঝুঁকে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দুদেশের মধ্যকার বাণিজ্যের এই অসমতা কমাতে চাইছে।
বাংলাদেশ সরকারের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সহযোগী ভূমিকা পালন করে সরকার। আমদানি ও রফতানি করে বেসরকারি খাত। ফলে এখানে তাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।’
সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের প্রস্তাবনা দেওয়া হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনটি বিষয় গুরুত্ব পাবে। প্রথমত, অশুল্ক বাধা দূর করা। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি খাত যেন বেশি আমদানি করে, সেটিতে আরও উৎসাহ দেওয়া, এবং তৃতীয়ত, মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো বা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে শ্রম খাতে সংস্কার, মেধাস্বত্ব অধিকার, ডিজিটাল অর্থনীতিসহ অন্যান্য বিষয়ের উল্লেখ থাকতে পারে।’
ভবিষ্যৎ আলোচনা
বাংলাদেশের প্রস্তাবনা দেওয়ার পর সেটির বিষয়ে আলোচনা করা হবে জানিয়েছে আরেকটি সূত্র।
তিনি বলেন, ‘দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি অল্প সময়ের মধ্যে দূর হয়ে যাবে— যুক্তরাষ্ট্র এমন ধারণা পোষণ করে না। তবে তারা দেখতে চায়, বাংলাদেশ বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এর সুফল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাচ্ছে।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে আরেকটি বিষয় আমরা তাদেরকে বলেছি এবং আবারও বলবো। গোটা আলোচনায় শুধুমাত্র পণ্য নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু সেবা খাতে আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকি। সেটিও যেন তারা বিবেচনায় নেয়।’
সরকারে বিভিন্ন পদক্ষেপ
নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসার পরপরই অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মাদ ইউনূস তাৎক্ষণিকভাবে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশীরউদ্দিন ইউএসটিআরে তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, শুল্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন।
এর পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার অংশ হিসেবে সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দুই ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি বাংলাদেশ সফর করেছেন। তারা প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এসব বৈঠকে বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে সম্পর্কে তারা জানতে চেয়েছেন।
লুৎফে সিদ্দিকী ওয়াশিংটনে ইউএসটিআর-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ব্রেন্ডন লিঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলায় বাংলাদেশের গৃহীত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো বোঝার আগ্রহ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিক্রিয়ায়, বাংলাদেশ বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কৌশলের অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বৃদ্ধি এবং মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।