প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে চীনের প্রতি ‘বেশি ঝুকে পড়ার’ ক্ষেত্রে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও কনটেন্টগুলোর ওপর অধিকতর অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিৎ জনকল্যাণমুখী বিষয়গুলোর মধ্যে সরাসরি সম্পৃক্ততা। টেকসই সম্পর্কের জন্য দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ও যোগাযোগ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে মূল্য দিতে হবে দুই পক্ষকেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনগণ ও অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে পানিসম্পদ ও কৃষি খাত। যেমন বীজ উৎপাদন, পোল্ট্রি, পোস্ট হারভেস্ট ব্যবস্থাপনা, ভোকেশনাল ও কারিগরি শিক্ষা ও প্রযুক্তি হস্তান্তর ইত্যাদি; যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, উৎপাদনশীলতা বাড়াবে ও উন্নয়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে। অবকাঠামোয় বড় বড় প্রকল্পের পাশাপাশি চীন এসব বিষয়ে সহায়তা দিলে জনগণ উপকৃত হবে ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক টেকসই হবে।
আওয়ামী লীগের আমলে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির যে অভিযোগ এবং এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার জন্য ভারতকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু ওই তিন নির্বাচনের পর যে কয়টি দেশ প্রথমে আওয়ামী লীগ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিল তাদের মধ্যে চীন অন্যতম।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. সুফিউর রহমান বলেন, ’চীনের মূল নীতি হচ্ছে তারা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। বেইজিং সাধারণত সরাসরি কোনও নির্দিষ্ট দেশের জনগণের উদ্বেগের কথা বলে না। এরফলে অনেক সময় বড় ধরনের ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত এক দশকে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে জালিয়াতির নির্বাচনের পর চীনাদের বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেওয়া হয়েছে এবং সেটি আসলে যান্ত্রিক ছিল। তারা আসলে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি মনোযোগ দেয়নি। তাই এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি জনগণের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি।’
ঐতিহাসিক সফর
প্রধান উপদেষ্টার সফরকে ঐতিহাসিক হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ব্যাপ্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের চেয়ে নতুন বিষয় ও দিক বিবেচনায় ‘কম তাৎপর্যপূর্ণ’ বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই সফরকে যুগান্তকারী সফর হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদি ২০১৬ সালে শি জিনপিংয়ের সফরের তুলনা করেন, তাহলে সফর দুটি তুলনীয় নয়। তবে এই সফরটি রাজনৈতিক কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গত বছরের জুলাই মাসে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর এই সফর হয়েছে। তাই এটি একটি যুগান্তকারী। সফর দুটির প্রেক্ষিত ও মাত্রা ভিন্ন।’
দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সম্পর্কের নতুন গতিপথের সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটেও এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। এই সফর একটি সুযোগও তৈরি করেছে এবং দিক পরিবর্তন সম্ভবত যুগান্তকারী বলে তিনি জানান।
নতুন সহযোগিতা
আপাতদৃষ্টিতে ভারতের আপত্তির কারণে পানি সম্পদ ও কানেক্টিভিটি ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা অত্যন্ত কম ছিল। তবে এবারের সফরে এ বিষয়ে বড় ধরনের অগগ্রতি হয়েছে।
এ বিষয়ে আরেকজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তিস্তা প্রকল্পে চীনা কোম্পানিগুলো অংশ নিতে পারবে। এর আগে ভারতের আপত্তির কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। আর্থিকভাবে এটি বড় নয়, তবে এর প্রভাব অনেক বেশি। তাই এটি এমন একটি বিষয় যা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।‘
‘জলপ্রবাহ পূর্বাভাস, নদী খনন, বন্যা সুরক্ষা এবং খরা প্রতিরোধ ইত্যাদি পানি খাতের সহযোগিতা বিষয়ে বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে নতুন ধরনের আলোচনা হচ্ছে এবং সামনের দিনগুলোতে তা অব্যাহত থাকবে বলেও ধারণা করা যায়’, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে নতুন আরেকটি সহযোগিতার ক্ষেত্র হচ্ছে সংযোগ। মোংলা বন্দরের আধুনিকীকরনে চীনের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এরফলে আঞ্চলিক সংযোগ কৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারে।
এ বিষয়ে ওই কূটনীতিক বলেন, ‘মোংলা বন্দরে চীনের সহযোগিতা আর্থিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে, তবে এর প্রভাব বিশাল হতে পারে। শেষ পর্যন্ত এর একটি আঞ্চলিক কৌশলগত মূল্য থাকতে পারে। সুতরাং এই উদ্যোগ এই অঞ্চলে সংযোগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারে।’