জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশে তারুণ্যের একতার মধ্য দিয়েই দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করছে সরকার। সেই লক্ষ্যেই এবারের আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে— ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের একতা: গড়বে আগামীর শুদ্ধতা।’ এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে ‘সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। আগামী মাসের মধ্যেই কমিশন দুদক সংস্কারে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল একটি সূত্র।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসটি পালন করবে সোমবার (৯ ডিসেম্বর)। বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) দিবসটি উদযাপন করবে। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, একটি দক্ষ ও সৎ কমিশন ছাড়াও দুর্নীতি প্রতিরোধে পারিবারিক শিক্ষার প্রয়োজন বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে গত ২৮ আগস্ট বেশ কিছু সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এছাড়াও সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানকে প্রধান করে দুদক সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে সরকার। যার কাজ এখন চলমান। আগামী মাসের ৭ তারিখের মধ্যেই দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করার কথা রয়েছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে গত ২৮ আগস্ট দেওয়া টিআইবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নজিরবিহীন রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার মূল প্রত্যাশা হচ্ছে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার উপযোগী রাষ্ট্রকাঠামো ও পরিবেশ তৈরি করা। কর্তৃত্ববাদী সরকারের বহুমাত্রিক দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ ও অর্থপাচারসহ বহুমুখী দুর্বৃত্তায়নের বিচারহীনতা নিশ্চিত করা। ‘নতুন বাংলাদেশে’ রাষ্ট্র-সংস্কার ও জাতীয় রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মূল অভীষ্ট হতে হবে দুর্নীতি তথা ক্ষমতার অপব্যবহারের এই বিচারহীনতার মূলোৎপাটন করা।
গত ৮ জুলাই রাজধানীতে এক মানববন্ধনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা এমন দুদক চাই, যেখানে ব্যক্তি-দলীয় প্রভাব থাকবে না। কমিশন নিয়োগ দলীয় প্রভাবমুক্ত হতে হবে। আমলাতান্ত্রিক সচিব এবং মহাপরিচালক যারা আছেন, তাদের মধ্যে যে আমলাতান্ত্রিক আনুগত্য— সেটি নির্মূল করতে হবে। এই দুটি বিষয় সম্পূর্ণ করতে না পারলে আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন কখনও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না।’
এ বিষয়ে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুদকের যে আইন আছে, সেটি একটি ভালো আইন বলেই আমার ধারণা। আইনের কারণে যে দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না বা দুর্নীতি কমছে না, তা নয়। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও কমানো দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে সম্ভব বলে মনে করি না। দুদকে কেউ অভিযোগ করলে তারা অনুসন্ধান ও তদন্ত করে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও দুদক দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত করে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেটা করা হয়, সেটা হচ্ছে যেমন- আমি আপনাকে পছন্দ করি না, আপনার বিরুদ্ধে লেগে গেলাম। স্বতঃপ্রণোদিত হওয়া উচিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির সংবাদগুলো বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া। যেমন- হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুসহ অনেক দুর্নীতির অনুসন্ধান হয়েছে গণমাধ্যমের খবর থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে।’
তিনি বলেন, ‘দুদক যদি ক্ষমতাসীনদের পদলেহনকারী হয় তাহলে কোনও আইন ও সংস্কারেই লাভ হবে না। স্বাধীনচেতা না হয়ে যদি একচোখা লোকেরা দায়িত্বশীল পদে থাকে, তাহলে তো সেই দায়িত্ব পালন হবে না। যে পর্যন্ত স্বাধীনচেতা, ন্যায়পরায়ণ, পক্ষপাতিত্বহীন লোকজন দায়িত্বশীল পদগুলোতে না থাকবে, সে পর্যন্ত দুর্নীতি দমন করা সম্ভব না। দুর্নীতিবাজদের ধরাও সম্ভব না। দুদক হচ্ছে একটা দন্তহীন বাঘ।’
দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘পরিবার থেকেই প্রথমে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ শুরু করতে হবে। প্রত্যেকেই আগে নিজেকে দুর্নীতি থেকে দূরে রাখতে হবে। সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষাটা দিতে হবে। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মোটিভেশন দিতে হবে। পাঠ্যবইয়ে দুর্নীতিবিরোধী চ্যাপ্টার রাখতে হবে।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে তারুণ্যের অন্যতম মুখ্য ভূমিকা থাকতে পারে। এর সঙ্গে তরুণদের যুক্ত করা হলে আগামীর শুদ্ধতা নিশ্চিত হবে বলে মনে করেন অনেকে। সেই কারণেই আন্তর্জাতিকভাবে এই স্লোগানকে সামনে রেখে এবারের দিবসটি পালন করা হচ্ছে। ’
দুদকের যত আয়োজন
আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে সোমবার (৯ ডিসেম্বর) আলোচনা সভার আয়োজন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সকাল ১০টায় রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। বিশেষ অতিথি থাকবেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।
এর আগে দিবসটি উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৮টায় সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা ও দুদকের পতাকা উত্তোলন করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে শান্তির প্রতীক পায়রা এবং ফেস্টুনসহ হিলিয়াম গ্যাসভর্তি বেলুন ওড়ানো হবে। অনুষ্ঠানে শৃঙ্খলা রক্ষায় ১০ জন বিএনসিসি সদস্য, ১০ জন স্কাউটস সদস্য এবং ১০ জন গার্ল গাইডস সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।