ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন ঢাকা সফররত মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। দুই নেতা দুর্নীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়বিচারকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবসা-বিনিয়োগ বাড়িয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে একমত হয়েছেন।
শুক্রবার (৪ অক্টোবর) দুপুরে এক সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশে আসেন আনোয়ার ইব্রাহিম। রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে ঢাকার একটি হোটেলে ড. ইউনূসের সঙ্গে তিনি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে করেন তিনি। পরে দুজন যৌথভাবে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন।
এ সময় ৮৪ বছর বয়সী ড. ইউনূস রাষ্ট্রপরিচালনায় নিজের অনভিজ্ঞতার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করলে ‘দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার সামনে এটা কোনও বিষয় নয়’ বলে মন্তব্য করেন প্রবীণ রাজনীতিক আনোয়ার ইব্রাহিম।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আশিয়ানের চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া। সে জন্য ড. ইউনূস প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে বৈঠকে অভিনন্দন জানান। আশিয়ানের খাতভিত্তিক আলোচনায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তকরণের প্রস্তাব করেন তিনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিষয়টি নিয়ে সচেষ্ট হবেন বলে জানান ইব্রাহিম।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আলোচনায় আমরা দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো আরও সক্রিয় (ভাইব্রেন্ট) করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমি তাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘটনাটি বর্ণনা করেছি। এই দ্বিতীয় স্বাধীনতার অন্বেষায় তরুণদের আত্মদানের বিষয়টি স্মরণীয়। তারা বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশের জন্য লড়েছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকার কাজে হাত দিয়েছে। ঐতিহাসিক এমন মুহূর্তে ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার অবিরাম সমর্থনের জন্য আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সহযোগিতার তিনটি প্রধান ক্ষেত্র নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলাপ করেছি। রাজনীতি, ব্যবসা-বিনিয়োগ, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সহায়তা। জোর করে বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের নিরাপদে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি আমরা আলোচনা করেছি। আশিয়ানের ফোরামে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি জোর গলায় আলোচনা তোলার জন্য মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায় এবং পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে নিয়মিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার গুরুত্বের বিষয়টি নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট সম্পাদনের জন্য ট্রেড নেগোশিয়েশন কমিটির বৈঠক শুরু করার আশা করছি। কৃষি, জ্বালানি, শিক্ষা, হালাল অর্থনীতি, সেমি-কন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি, কানেক্টিভিটি, ব্লু-ইকোনমি, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রতিরক্ষা ও যুব উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার নতুন নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেছি।
সেবা খাতে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সেবা খাতও দুই দেশের জন্য সম্ভাবনাময়। এই খাতে দুই দেশের জন্যই লাভজনক বিষয়গুলো নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারি। ভবিষ্যতে সহযোগিতার আরও দুটি খাত হতে পারে মুবিলিটি ও ফাইন্যান্সিং।
তিনি বলেন, দুই দেশের অর্থনীতিতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিয়ে করা এমওইউর বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বাংলাদেশ থেকে পেশাদার ও শ্রমিক নেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়েও কথা হয়েছে। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বিনিময়, ফ্যাকাল্টি এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। গভীর সমুদ্রের মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাংয়ের মধ্যে কৌশলগত কানেক্টিভিটির বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেয়েছিল।
দুই নেতার বৈঠকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়ার চলমান কর্মসূচিগুলো কার্যকর করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়।
নতুন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে ভাই সম্বোধন করে ‘বিপ্লব’ ও ‘সংগ্রাম’ বাংলা শব্দগুলো উচ্চারণ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে আগে ফোন করে সমর্থন জানানোর কথাটিও তিনি পুনরায় উল্লেখ করেন। জেলজীবনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথাও বলেন তিনি। আর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চার দশক ধরে পরিচয়ের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
সরকার পরিচালনায় নিজেকে অনভিজ্ঞ হিসেবে ড. ইউনূস উল্লেখ করলেও এটা কোনও বিষয় নয় মন্তব্য করে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, আপনার সক্ষমতা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আপনার দীর্ঘ প্রচেষ্টার কাছে এই অনভিজ্ঞতা ব্যাপার না।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ ফিলিস্তিনের গাজা ও লেবাননের দিকে তাকালে কী দেখা যায়? মানবতা ও ন্যায়বিচারের অভাব।
ব্যবসা ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, এখানে মালয়েশিয়ার কোম্পানি আছে, সেখানেও বাংলাদেশি বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে। এখানে আরও কার্যকর অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব প্রয়োজন। কোম্পানিগুলোর দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যেকোনও সমস্যা দেখা দিলে যেন দ্রুত তা সমাধান হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। অর্থনীতির মূল বিষয়গুলো ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে দুই দেশের সরকারের বিশেষ গুরুত্বের বিষয়টি কোম্পানিগুলো দেখছে। দুর্নীতির বিষয়ে আমরা কোনও ছাড় দেবো না।
তিনি বলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়েও আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে পারি। এ বিষয়ে আরও আলোচনা হতে পারে।
আশিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হবেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য আপনার প্রচেষ্টার বিষয়ে আমার আস্থা আছে। নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার বিষয়ে আপনার প্রচেষ্টাও আমি বিশ্বাস করি।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৫৮ সদস্যের প্রতিনিধিদলে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্য ও বিনিয়োগমন্ত্রী, পরিবহন উপমন্ত্রী, ধর্ম বিষয়ক উপমন্ত্রী, দুজন সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ কয়েকজন প্রতিনিধি আছেন।