ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে দেশের বিভিন্ন জেলায় হালকা থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সঙ্গে চলছে তীব্র ঝোড়ো বা দমকা হাওয়া। উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলোচ্ছ্বাস। জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। ঝড়ের দাপটে ভেঙে পড়ছে ঘরবাড়ি ও গাছপালা। বেশ কয়েকটি জেলা বিদ্যুৎহীন আছে। এ অবস্থায় এ পর্যন্ত বরিশাল, ভোলা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও খুলনায় মোট আট জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রবিবার (২৬ মে) সন্ধ্যা থেকে সোমবার (২৭ মে) দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই আট জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধিরা।
বরিশাল প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ে নগরীর রুপাতলী এলাকায় চারতলা ভবনের সাইড দেয়াল ধসে পার্শ্ববর্তী হোটেলের ওপর পড়ে দুজন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন হোটেল মালিক লোকমান হাওলাদার ও কর্মচারী মোকসেদুল। আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন অপর কর্মচারী শাকিব। তারা নগরীর রুপাতলী এলাকার বাসিন্দা।
হোটেল মালিকের ছেলে মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, ভোর রাত ৩টার দিকে ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী চারতলা ভবনের ওপর থেকে দেয়াল ধসে দোকানের ওপর পড়ে। এতে ঘটনাস্থলে তার বাবা এবং এক কর্মচারী নিহত হন। অপর কর্মচারীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঝালকাঠির নলছিটির বাসিন্দা নুরুল হকের চারতলা ভবনের কার্নিশ ঘেঁষে দেয়ালটি করা ছিল। ঘূর্ণিঝড়ে দেয়ালের বেশিরভাগ অংশ দোকানের ওপর ধসে পড়ে।
জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ওই দুই পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে ভবন মালিকের কোনও ত্রুটি আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হবে।
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিচুল হক জানান, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দুজনের লাশ এবং একজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন।
খুলনা প্রতিনিধি জানান, গাছচাপায় লাল চাঁদ মোড়ল (৩৬) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ২৬ মে রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পর ২৭ মে সকালে বটিয়াঘাটার বাসায় ফিরে যান তিনি। এরপর সেখানে গাছের নিচে চাপা পড়ে মারা যান। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. নাজমুল হুসাইন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ভোলা প্রতিনিধি জানান, দৌলতখানে ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ঘরের ভেতরে গাছ চাপা পড়ে শিশু মাইশার (৪) মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (২৭ মে) ভোর ৪টার দিকে পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। মাইশা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের মনির হোসেনের মেয়ে। এর আগে ভোরে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ঘর চাপা পড়ে মনেজা খাতুন (৫০) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। এ নিয়ে ঝড়ে জেলায় দুজনের মৃত্যু হলো।
মাইশার বাবা মনির জানান, রবিবার রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি সবাই। ভোর ৪টার দিকে হঠাৎ একটি গাছ আমার ঘরের ওপর পড়ে। এতে টিনের চালে চাপা পড়ে মাইশা মারা যায়। আমিও চাপা পড়ি, স্থানীয়রা এসে উদ্ধার করেছেন।
বসতঘরে চাপা পড়ে মারা যাওয়া মনেজা খাতুন লালমোহন উপজেলার চর উমেদ গ্রামের আব্দুল কাদেরের স্ত্রী। রাতে মনেজা খাতুন তার এক নাতিকে নিয়ে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। ভোরে ঝোড়ো বাতাসে তার টিনের ঘর ভেঙে চাপা পড়েন। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান মনেজা। অক্ষত আছে তার নাতি।
এ বিষয়ে দৌলতখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সত্যরঞ্জন খাসকেল বলেন, ঘরের ওপর গাছ চাপা পড়ে এক শিশুর মৃত্যুর খবর পেয়েছি। ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, মৃত দুজনের পরিবারকে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।
অপরদিকে, ঝড়, বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে জেলার উপকূলীয় অঞ্চল। উপকূলের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সব ফসল লোনাপানিতে ডুবে গেছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, মনপুরা, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলায় মোট ১০টি স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, রবিবার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালি আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে শওকত মোড়ল নামে এক বৃদ্ধ মারা যান।
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, রবিবার বিকালে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধূলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্লাবিত এলাকা থেকে বোনকে রক্ষা করতে গিয়ে মো. শরীফুল ইসলাম নামে একজনের মৃত্যু হয়। একই রাতের যেকোনও সময় বাউফল উপজেলা শহরের হাসপাতাল সড়কের একটি পরিত্যক্ত টিনশেড ঘরে আশ্রয় নেন নাজিরপুর এলাকার আব্দুল করিম (৬৫)। সেখান চাপা পড়ে মারা যান তিনি।
এ ছাড়া সোমবার (২৭ মে) সকালে ঘরের ওপর উপড়ে চাপা পড়ে প্রাণ হারান দুমকি উপজেলার নলদোয়ানি গ্রামের জয়নাল আবেদীন হাওলাদার (৭০)। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত জেলায় প্রাণহানি ঘটলো ৩ জনের।
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, রামগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ চাঙ্গিরগাও গ্রামে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে বসতঘর চাপা পড়ে নিস্পা নামের ৮ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে গুরুতর আহত হয়ে রামগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন শিশুটির নানি হোসনেয়ারা বেগম (৬৩)।
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানিয়েছেন, নগরীর বায়েজিদ থানার টেক্সটাইল এলাকায় দেয়ালচাপায় মারা গেছেন সাইফুল ইসলাম হৃদয় নামের এক পথচারী।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝড়ের সময় ভারী বৃষ্টি হচ্ছিল। এ সময় একটি দেয়ালের পাশে আশ্রয় নেন হৃদয়। হঠাৎ দেয়ালটি ভেঙে পড়লে চাপা পড়ে মারা যান তিনি। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস তার মরদেহ উদ্ধার করে।