X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

লবণাক্ততা রোধে যা বলা আছে ডেল্টা প্ল্যানে

শফিকুল ইসলাম
১৬ মে ২০২১, ০৯:০০আপডেট : ১৭ মে ২০২১, ১৭:৪৪

জার্মান ওয়াচের তথ্যমতে, জলবায়ু বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম। বিপর্যয়ের যে ক’টি কারণ আছে তার মধ্যে লবণাক্ততা অন্যতম। ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে এই সমস্যা।

জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম- সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী ও বরগুনা। পুকুর, ডোবা-নালা, নদী ও খাল-বিলের পানিতে লবণাক্ততা রয়েছে বরিশালসহ আরও কয়েকটি জেলাতেও। লবণাক্ততা রোধে সরকারের শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-তে আছে বেশকিছু কর্মপরিকল্পনা। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে এমন অনেক জেলা আছে যেখানকার নদী-খালে ছয়মাস পানি থাকে, বাকি ছয়মাস শুকনো মৌসুম। ওই সময় ফসলি জমি ফেটে চৌচির হয়ে থাকে। আবার সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৪০টি উপজেলাজুড়ে আছে বিস্তৃত ভাটি অঞ্চল। একই দেশে এমন পার্থক্যের জন্য দায়ী করা হয় জলবায়ু বিপর্যয়কেই। এসব জেলা নিয়েও ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা রয়েছে ডেল্টা প্ল্যানে।

ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণায়ন ও পরিবেশ রক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের অবস্থান ও পদক্ষেপ বিশ্বসমাজে প্রশংসিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড’-এর বরাদ্দ আরও বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও এ মহাপরিকল্পনায় স্থান পেয়েছে।

লবণাক্ততা রোধে যা বলা আছে ডেল্টা প্ল্যানে ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশের সুবিধা

ডেল্টা প্ল্যানে বলা হয়েছে, এতোসব সমস্যার পাশাপাশি ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশের কিছু সুবিধাও রয়েছে।

প্রথমেই আছে উর্বর জমি। এখানকার মোট ভূমির ৬৫ শতাংশই কৃষিজমি। ১৭ শতাংশ বনভূমি। ১০ শতাংশ জলাভূমি ও ৮ শতাংশ শহর এলাকা। নদ-নদী আছে সাত শ’রও বেশি। জলাভূমির মোট আয়তন ৪ দশমিক ৭০ মিলিয়ন হেক্টর।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সমুদ্রপথে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে। অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে এর কারণে। গতিশীল অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ব্যবস্থাও রয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ৬ হাজার কিলোমিটার।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন রয়েছে বাংলাদেশে। যার আয়তন প্রায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে জলভাগ ১ লাখ ৭৫ হাজার ৪০০ হেক্টর। সমৃদ্ধ প্রতিবেশও রয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে ২টি রামসার সাইট, ১৪টি ইসিএ (ইকলোজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া), ১৭টি জাতীয় উদ্যান, ২৮টি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য, ৮টি ইকোপার্ক এবং ২টি বোটানিক্যাল গার্ডেন।

৫টি গুরুত্বপূর্ণ ইসিএ হলো- হাকালুকি হাওর (১৮ হাজার ৮২ হেক্টর), টাংগুয়ার হাওর (৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর), সোনাদিয়া দ্বীপ (৪ হাজার ৯১৬ হেক্টর), সেন্টমার্টিন দ্বীপ (৫৯ হেক্টর) এবং টেকনাফ উপদ্বীপ (১০ হাজার ৪৬৫ হেক্টর)।

সরকারের ডেল্টা পরিকল্পনায় ইসিএতে ৮০০-এর বেশি প্রজাতি চিহ্নিত করা গেছে বলে উল্লেখ রয়েছে।

লবণাক্ততা রোধে যা বলা আছে ডেল্টা প্ল্যানে ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-

১। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা: ২০৫০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা ১.৪ থেকে ১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে।

২। বৃষ্টিপাতের তারতম্য: ২০৩০ সালের মধ্যে বৃষ্টিপাত বাড়বে বাংলাদেশে। তবে দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমার আশঙ্কা রয়েছে।

৩। বন্যার আশঙ্কা: দেশের প্রায় ৭০ ভাগ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ মিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থিত। এতে বন্যার আশঙ্কাও প্রবল।

৪। খরা মোকাবিলাও একটি চ্যালেঞ্জ- মূলত কৃষিজনিত খরা।

৫। নদী ভাঙন: প্রতিবছর নদীভাঙনে প্রায় ৫০ হাজার বসতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

৬। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ: ২০৫০ সালের দিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা শূন্য দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক শূন্য মিটার বাড়তে পারে। লবণাক্ততা ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ এলাকায় ১ পিপিটি এবং ২৪ শতাংশ এলাকায় ৫ পিপিটি পর্যন্ত বাড়তে পারে।

৭। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ও পরিমাণ বাড়তে পারে।

৮। জলাবদ্ধতা।

৯। পলি জমা।

১০। আন্তঃদেশীয় নদী ব্যবস্থাপনা।

লবণাক্ততা রোধে যা বলা আছে ডেল্টা প্ল্যানে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৌশল কাঠামো

ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এ বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জগুলো মেকাবিলার কৌশল কাঠামো নির্দিষ্ট করা হয়েছে তিনটি।

প্রথমটি হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ের কৌশল। এর একটি হচ্ছে- বন্যার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আর অন্যটি স্বাদুপানির ব্যবস্থাপনা।

দ্বিতীয়ত- ৬টি হটস্পটের জন্য কৌশল কাঠামো। এগুলো হচ্ছে- প্রথম দফা ২০৩০ সাল, ২য় দফা ২০৪১ থেকে ২০৫০, ২০৬১ থেকে ২০৭১, ২০৮০, ২০৯১ এবং চূড়ান্ত ধাপটি হচ্ছে ২১০০ সাল।

সর্বশেষ তৃতীয়টি হচ্ছে- পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয় ব্যবস্থাপনা কৌশল। এর মধ্যে রয়েছে- টেকসই ভূমি ব্যবহার এবং স্থানিক পরিকল্পনা, কৃষি খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, এবং জীবিকা, আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনা, গতিশীল অভ্যন্তরীণ নৌ-ব্যবস্থাপনা এবং সমুদ্র অর্থনীতি ও নবায়নযোগ্য শক্তি।

পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার জাতীয় কৌশল

সরকারের এক শ’বছরের প্রণীত ডেল্টা প্ল্যানে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার জাতীয় কৌশলপত্রে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

এর জন্য যেসব কার্যক্রম নিতে হবে সেগুলো হচ্ছে-

ক) বেসিন ওয়াইড পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।

খ) প্রধান নদীগুলোয় নতুন সেচ প্রকল্প গ্রহণ এবং স্থানীয় পর্যায়ের বিদ্যমান জলাধার যেমন ডোবা, বাওর, পুকুর পুনঃখনন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে পানি সংরক্ষণ এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ।

গ) সম্ভাব্যতা জরিপের মাধ্যমে রাবার বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন। (বর্তমানে ৩৫০টি রাবার বাঁধ কার্যকর রয়েছে)।

ঘ) আঞ্চলিক নদনদীগুলোর প্রবাহ বাড়াতে পদক্ষেপ গ্রহণ। নদী ও জলাভূমি পুনরুদ্ধারে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব প্রদান। ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ ও তা সংরক্ষণ।

ঙ) নগর এবং গ্রামীণ নদীতে স্বাদুপানির প্রবাহ বাড়ানো ও সার্বিকভাবে দূষণমুক্ত রাখা।

আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনা

সরকারের ডেল্টা প্ল্যানে আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি কৌশলের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-

ক) উজানের নদীগুলো থেকে পানি সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা।

খ) উজানের পানি প্রবাহের বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় রেখে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে প্রয়োজনে দেশের অভ্যন্তরে সম্ভাব্য বাঁধ বা ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা।

গ) পানিসংক্রান্ত কূটনীতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান এবং সংঘাত প্রতিরোধ করা।

ঘ) তিস্তার পানিবণ্টন সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন তৎপরতা অব্যাহত রাখা।

ঙ) চাহিদাভিত্তিক যৌথ নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ।

চ) পানিসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে তৃতীয় পক্ষকে (বহুপক্ষীয় বা দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বা দেশ) সম্পৃক্তকরণ এবং অববাহিকাভিত্তিক বন্যার পূর্বাভাস পদ্ধতির উন্নয়ন।

//এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, এ সব সমস্যা নিরসনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল-ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণের কথা বলা হয়েছে এই মহাপরিকল্পনায়। চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখে সেভাবেই ২০৩০ সাল নাগাদ প্রথম ধাপে ৮০টি প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো পর্যায়ক্রমে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্য দিয়েই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাদুপানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে। সমাধান হবে প্রকট খরা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগও।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ অনুমোদন পায়। এর আগের ৪৭ বছরে দেশে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, কৃষি উন্নয়নে বহু পরিকল্পনার পরও সরকার আগামী ১০০ বছরের জন্য ডেল্টা প্ল্যান গ্রহণ করে।

এ পরিকল্পনার আওতায় আছে সারা দেশ। দেশের নদ-নদী, জলাভূমি, মাটি, পাহাড়, সমতল, হাওরসহ যাবতীয় প্রাকৃতিক ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করে এ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি চূড়ান্ত করার আগে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ, বিনিয়োগ, অর্থায়ন ইত্যাদি বিষয়ে ২৬টি বেইজলাইন সমীক্ষাও করতে হয়েছে।

/এফএ/ইউআই/
সম্পর্কিত
বন্যা পরবর্তী স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের আহ্বান
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈশ্বিক সতর্কতা জারি
‘২০৫০ সালের মধ্যে বরেন্দ্র অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে’
সর্বশেষ খবর
মিরপুর-ডেমরায় আ. লীগের ঝটিকা মিছিল
মিরপুর-ডেমরায় আ. লীগের ঝটিকা মিছিল
আসামি গ্রেফতারে পূর্বানুমতি: ডিএমপির স্মারকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট
আসামি গ্রেফতারে পূর্বানুমতি: ডিএমপির স্মারকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট
চলন্ত অটোরিকশায় পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, দগ্ধ ২ নারী
চলন্ত অটোরিকশায় পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, দগ্ধ ২ নারী
ছয় দফা দাবিতে আগারগাঁওয়ে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের মহাসমাবেশ
ছয় দফা দাবিতে আগারগাঁওয়ে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের মহাসমাবেশ
সর্বাধিক পঠিত
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, বিপাকে পুলিশ
আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, বিপাকে পুলিশ
রাবির ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ৩ ভুল
রাবির ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ৩ ভুল
হিন্দু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায় হত্যা: নিন্দা জানালো ভারত
হিন্দু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায় হত্যা: নিন্দা জানালো ভারত
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল নিয়ে ডিএমপির বার্তা
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল নিয়ে ডিএমপির বার্তা