‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো। তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’−রবীন্দ্রনাথের এই গান ছাড়া বাংলা নববর্ষের সকাল যেন পূর্ণতা পায় না। স্বাধীনতার পর থেকে রমনা বটমূলে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে গান গেয়ে বরণ করা হতো নতুন বছরকে। বাঙালির প্রাণের এই উৎসবে আরও রঙ লাগিয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। বৈশাখকে বরণ করতে সকাল থেকে থাকে কত আয়োজন। এবার সেসব কিছুই নেই। উৎসবের নগরীতে এখন সুনসান নীরবতা। করোনাভাইরাসের থাবায় প্রাণহীন বৈশাখ। শুধু রাজধানী ঢাকা কেন, দেশের কোথাও কোনও আয়োজন হয়নি।
বাংলাদেশের জন্মের পর এই প্রথমবার বাংলা নববর্ষের সকাল ছিল নীরব। রমনা বটমূলে নেই সেই সুরের ছোঁয়া, চারুকলা থেকে বের হয়নি মঙ্গল শোভাযাত্রা। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বছর সবাইকে ঘরে বসে নববর্ষ পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে নববর্ষের সব আয়োজন।
নববর্ষের প্রথম প্রহরে ফাঁকা ছিল রাজধানী। পহেলা বৈশাখের প্রাণের উৎসবের শুরু হয় যেই মঞ্চে, সেটিও ছিল বন্ধ। রমনা পার্কের সবক'টি গেট বন্ধ। অথচ প্রতিবছর যেখানে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। রাস্তায় যানবাহন নেই বললেই চলে। ভাসমান মানুষ আর অতি প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষ ছাড়া আর তেমন কাউকে দেখা যায়নি।
রমনা পার্কের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য জানান, সরকারের নির্দেশে বন্ধ রাখা আছে রমনা পার্ক। এখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। রমনা পার্কের আশপাশের এলাকাও জনশূন্য। শাহবাগ এলাকাতেও নেই তেমন মানুষের আনাগোনা।
সোমবার (১৩ এপ্রিল) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাঙালির সার্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। প্রতিটি বাঙালি আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপন করে থাকেন এই উৎসব। এ বছর বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে পহেলা বৈশাখের বাইরের সব অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে বৃহত্তর জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে।’
তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে রমনা পার্ক, চারুকলা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ নগরীর নানা স্থান মানুষের ভিড়ে মুখরিত থাকে এদিনটি। গ্রামীণ মেলা, হালখাতাসহ নানা অনুষ্ঠানে গোটা দেশ মেতে ওঠে। এবার সবাইকে অনুরোধ করবো কাঁচা আম, জাম, পেয়ারা, তরমুজসহ নানা মৌসুমি ফল সংগ্রহ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে বসেই নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করুন। আপনারা বিনা কারণে ঘরের বাইরে যাবেন না। অযথা কোথাও ভিড় করবেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।’
জনসমাবেশ নিষিদ্ধ থাকায় এইবছর বাতিল হয়েছে পহেলা বৈশাখের সব আয়োজন। তবে ডিজিটালি বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সীমিত আকারে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কথা জানিয়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। ‘উৎসব নয়, সময় এখন দুর্যোগ প্রতিরোধের’ এ প্রতিপাদ্যে সীমিত আকারে বর্ষবরণের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন।
মঙ্গল বার্তা নিয়ে আসা মঙ্গল শোভাযাত্রাও বাতিল করা হয়েছে জাতির মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যদি এমন হতো আমাদের নিজেদের কারণে কিংবা ফান্ডের কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করতে পারিনি, তাহলে হয়তো অনেক খারাপ লাগতো। নিজেদের কাপুরুষ মনে হতো। কিন্তু এখন আমরা যে যুদ্ধে নেমেছি, এই যুদ্ধের কৌশলটি হচ্ছে আমাদের ঘরে অবস্থান করা। এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার এটাই একমাত্র কৌশল। আমরা কিন্তু ভয়ে ঘরে অবস্থান করছি না। এই যুদ্ধে জয়ী হতে গেলে আমাদের এটাই মানতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমরা দেশ ও জাতির মঙ্গলের কথা চিন্তা করে করি। মঙ্গল শোভাযাত্রা না করাটা পুরা মানবজাতির মঙ্গলের জন্য নেওয়া সিদ্ধান্ত।’
ছবি: নাসিরুল ইসলাম