প্রতিষ্ঠার পর টানা ৩৩ বছর সুনামের সঙ্গেই টিকে ছিল লুৎফা একাডেমি। মাধ্যমিক পর্যায়ের এই স্কুলটিতে শতশত শিক্ষার্থী পড়াশুনা করতো। শিক্ষকদের বেতনও ছিল নিয়মিত। স্কুলের মাঠে শিক্ষার্থীদের হৈ-হুল্লোড়, প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আইসক্রিমের ভ্যান, বিক্রি হতো বাদাম কিংবা ঝিাল মুড়ি— এসবই এখন শুধু স্মৃতি। তবে সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের জরাজীর্ণ ভবনটি। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা শান্তিনগর-রাজারবাগ সড়ক সংলগ্ন চামেলীবাগের লুৎফা একাডেমি একনামে চিনতো সবাই। বর্তমানে এই স্কুলটির কার্যাক্রম বন্ধ রয়েছে। এমনকি স্কুলের জমিটিও কর্তৃপক্ষের দখলে নেই।
বুধবার (২৫ জুলাই) সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, স্কুলের যে মাঠটিতে স্কুল ড্রেস পরা শিক্ষার্থীরা দুপুরে খেলায় মেতে উঠতো, সেখানে ঘাষ-জঙ্গলে ভরে গেছে। টিফিনের ফাঁকে স্কুল গেটের পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা আইসক্রিমওয়ালার কাছে যেখানে শিক্ষার্থীরা আইসক্রিম কিনতো, সেখানে স্থাপন করা হয়েছে সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিন।
ভবনের ভেতরে ও বাইরে কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী পাহারা দিচ্ছেন। জরাজীর্ণ ভবনটিতে রাতেও নিরাপত্তাকর্মীরা পাহারা দেন এবং ভেতরের একটি কক্ষে শুয়েও থাকেন। বিশাল এই ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও পাহারাদারদের ঘর ছাড়া কোথাও আলো নেই। স্কুলভবনের সব গেট বন্ধ। ব্যস্ততম এলাকার এই ভবনটি এখন যেনো একটি ভুতুড়ে বাড়ি।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তারক্ষী মাসুদ জানান, এখানে কেউ থাকেন না। ভবনটি একটি কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে, ভেঙে বড় বিল্ডিং করার জন্য। সাইনবোর্ড টনিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সরকারের তালিকায় সারাদেশের অস্তিত্বহীন ১৮৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লুৎফা একাডেমি একটি। সম্প্রতি সরকার ইআইআইএনধারী (এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) অথচ বাস্তবে অস্তিত্ব বা কার্যক্রম নেই এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করে। এই তালিকা ধরে খুঁজে বের করা হয় লুৎফা একাডেমি নামের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
বন্ধ হওয়া লুৎফা একাডেমির সর্বশেষ ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এ এম মোবাশ্বেরুল হক ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চামেলীবাগের এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৮৩ সালে। এমপিওভুক্ত হয় ১৯৯২ সালে। এমপিওভুক্তির আগে ও পরে মিলিয়ে টানা ৩৩ বছর ভালোভাবেই চলেছে স্কুলটি। ভালো রেজাল্ট করা স্কুলটিতে পরীক্ষা কেন্দ্রও ছিল। তবে এমপিও বাতিল হওয়ার পর একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষকরা যে যার মতো সংসার চালাতে রোজগারের পথ খুঁজে নিতে থাকেন।
শেষ সময়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এ এম মোবাশ্বেরুল হক জানান, ১৯৮৩ সালে লুৎফা একাডেমি নামে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা নুরুল হুদা চৌধুরী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর স্ত্রী লুৎফা চৌধুরীর নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্ত্রী লুৎফা চৌধুরীকে তিনি নিয়োগ দেন। প্রতিষ্ঠাতা নুরুল হুদা স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে স্কুলটি এমপিওভুক্ত করান। রীতিমতো সুন্দরভাবেই চলতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী লুৎফা চৌধুরী প্রধান শিক্ষক হিসেবে সুনামের সঙ্গেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এ এম মোবাশ্বেরুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০০৫ সালে প্রধান শিক্ষক লুৎফা চৌধুরী মারা গেলে আহমদ জাফরি নামের একজন লোক স্কুলের জমি নিজের বলে দাবি করে মামলা করেন। তবে জমির মালিকানার বিষয়ে আদালতে কোনও কাগজ দেখাতে পারেননি তিনি। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জমি স্কুলের দখলে থাকার নির্দেশনা দেন আদালত। কিন্তু এ অবস্থাতেই কুচক্রীরা স্কুলের ছাত্রদের ওপর হামলা করে। এ হামলার ঘটনার পর থেকে স্কুলটিতে ছাত্র কমতে থাকে। ছাত্র কমে যাওয়ার কারণে ১৯৯২ সালে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির এমপিও বাতিল হয়ে যায় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এরপর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলটি চালিয়ে নিয়েছি। তারপর আর পারিনি। আমাদের টাকা ও শক্তিশালী লোক না থাকায় পারা যায়নি।’
তবে স্থানীয়রা জানান, জমির দখল ছেড়ে দিতে স্কুল পরিচালনা কমিটির সহায়তায় স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী স্কুল বন্ধ না হলে জমিটি স্কুলের দখলেই থাকতো। স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবনসহ জমি বেদখল হয়ে যায়। এরপর আর কেউ খোঁজ নেয়নি স্কুলের। মনে হয় দেখার কেউ নেই প্রতিষ্ঠানটির।
তবে এ এম মোবাশ্বেরুল হক বলেন, ‘আমাদের ক্ষমতা কম। এমপিও বন্ধ হওয়ার পর তবু চেষ্টা করেছি। স্কুল বন্ধ হওয়ার পর শিক্ষক-কর্মচারীরা যে যার মতো করে জীবন চালাচ্ছেন।’
বুধবার (২৫ জুলাই) বিকালে স্থানীয়দের সহায়তায় স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের খুঁজে বের করা চেষ্টা করার একপর্যায়ে সন্ধ্যায় মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে পিওন ফকরুল আলমের খোঁজ পাওয়া যায়। ফকরুল সেখানে একটি অস্থায়ী চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালান।
স্কুল বন্ধ হওয়ার পর স্ত্রী-সন্তানদের খাওয়া পরা জোগাড় করতে বাধ্য হয়ে সেখানে চায়ের দোকান দিয়েছেন বলে জানান ফকরুল। স্কুল কেন বন্ধ হলো তা নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি তিনি। শুধু বলেন, ‘স্কুল ভালোমতোই চলছিল। বন্ধ হওয়ার পর কোনও রকমে জীবন বাঁচাতে চা বিক্রি করছি। আপনি বেশি কিছু লিখলে আমার চা বিক্রিও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।’
আরও পড়ুন- যা আছে কারিগরি ও মাদ্রাসা এমপিও নীতিমালায়