পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির মামলাকে ‘অনুমানভিত্তিক’ ও ‘গুজব’ বলে উল্লেখ করে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছে কানাডার একটি আদালত। মামলার রায় বাংলাদেশের পক্ষে আসায় প্রশ্ন উঠেছে, এখন কী করবে সরকার? তারা কি বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেবে? এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এখনও কোনও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে এই রায়ের পর বিশ্বব্যাংক, টিআইবিসহ বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর জিমিয়াও ফানের কাছে ইমেইল করা হয়। জিমিয়াও ফানের পক্ষে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের মিডিয়া বিভাগের কর্মকর্তা মেহরিন এ মাহবুব এক ইমেইলে জানান, ‘বিশ্বব্যাংক তার অর্থায়িত প্রকল্পে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে থাকে। যখন বিশ্বব্যাংকের একটি তদন্ত শেষ হয়, তখন সেই তদন্তের অনুসন্ধান পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট দেশকে। যেন তারা বিবেচনায় নিতে পারে যে, এর মধ্য দিয়ে তাদের জাতীয় আইন ক্ষুণ্ন হয়েছে কিনা। পরবর্তীতে সেই সংশ্লিষ্ট দেশের পর্যবেক্ষণ বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত পর্যবেক্ষণ সেই দেশকেই দেওয়া হয়।’
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংকের তোলা দুর্নীতির অভিযোগকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করেছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেওয়ার পর ফেসবুকে যোগাযোগ করা হলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের আনা দুর্নীতির অভিযোগটি পদ্মা সেতু ও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল।’
কানাডার সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ইয়ান নরডেইমার মামলাটি নাকচ করে দেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমি নির্দোষ এ কথা আবারও প্রমাণিত হলো। এই ষড়যন্ত্রের কারণে আমাকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছে, জনগণের সামনে আমাকে ছোট হতে হয়েছে। পত্রিকাগুলো মনগড়া রিপোর্ট করায় আমার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। আজ তার জবাব দিল কানাডার আদালত।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) মতে, অভিযোগ প্রমাণের আগেই বিশ্বব্যাংক কেন পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করল, তার জবাব সরকারের চাওয়া উচিত। সংক্ষুব্ধ পার্টি হিসেবে সরকারের এই জবাব চাওয়া উচিত জানিয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আদালত যে রায় দিয়েছে, সেখানে কয়েকটা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। জল্পনা, গুজব, রটনার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল। যুক্তিগুলো আদালতের কাছে আমলযোগ্য হয়নি। সে কারণে মামলা খারিজ করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হলো বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগগুলো উত্থাপন করেছিল, সেগুলো যুক্তিহীন ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই অভিযোগের মাধ্যমে সরকার ও দেশের জনগণের ওপর কালিমা লেপন হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক দেশবাসীকে জানিয়েছিল যে তারা তদন্ত করে এই অভিযোগগুলো পেয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা আন্তর্জাতিক তদন্ত দল নিয়ে এসে তদন্ত করেছিল। সেই তদন্তেও তারা অভিযোগ অব্যাহত রাখলো। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তারা অর্থায়ন বন্ধ করলো। প্রমাণ হওয়ার আগে অর্থায়ন বন্ধ হলো কোন যুক্তিতে? এ ব্যাপারে সরকারের ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কানাডার আদালতে বাংলাদেশ নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে, বিষয়টি অবশ্যই স্বস্তির। তবে এই ঘটনার পর যেভাবেই হোক বাংলাদেশের ভাবমূর্তিরও উন্নতি হয়েছে। এর প্রমাণ হলো, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করে গেছেন। তারা বাংলাদেশের প্রতি সহনশীল। যেহেতু তারা সহনশীল, তাই আর কিছু করার আছে বলে আমি মনে করি না। তবে বিশ্বব্যাংক যদি তাদের অভিযোগ সম্পর্কে অনড় থাকতো তাহলে অন্য কিছু ভাবা যেতো। যেহেতু তারাও তাদের অভিযোগে অনড় থাকেনি, তাই এ মুহূর্তে আর কিছু ভাবার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।’
বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ফলে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুন্ন হয়েছে। এ কারণে বিশ্বব্যাংকের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।’ তিনি আরও বলেন, ‘তবে এটা ঠিক যে, তাদের কারণেই বাংলাদেশ প্রমাণ করতে পেরেছে চাইলে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করা সম্ভব। ওই ঘটনার পর আমরা অর্থনীতি সমিতির পক্ষ থেকে সেমিনার করে বলেছিলাম, বাংলাদেশের এখন উচিত নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করা। আজ পদ্মা সেতু স্বপ্ন নয়, বাস্তব।’
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় পদ্মা সেতু প্রকল্পে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া ব্যক্তিদের সরাসরি ‘দেশদ্রোহী’ বলছেন। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র লিখেছেন, ‘প্রমাণ ছিল বিশ্বব্যাংকের মনগড়া। আমি নিজে এই সাক্ষ্য তথ্যের পুরো উপাখ্যান প্রত্যক্ষ করেছি। এটা পুরোপুরি সাজানো ছিল। কারণ এতে সুনির্দিষ্ট কোনও বিবরণ ছিল না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক ষড়যন্ত্র করেছিল উল্লেখ করে জয় আরও লিখেছেন, ‘তারা ষড়যন্ত্র করেছিল তার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সম্মানহানির উদ্দেশ্যে। এরপর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বিশ্বব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিল পদ্মা সেতুর ফান্ড যেন বাতিল করার মাধ্যমে আমাদের সরকারকে শাস্তি দেওয়া হয়। সে তা করেছিল কারণ মুহাম্মদ ইউনূস বারবার তাকে বলছিল আমার মায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।’
কানাডার আদালতের রায়ের পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বরাবরই বলে এসেছেন পদ্মা সেতু নিয়ে কোনও দুর্নীতি হয়নি। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বব্যাংক ফিরে গেলেও শেখ হাসিনার সৎ সাহস ছিল বলে পদ্মা সেতুর কাজ নিজ উদ্যোগে শুরু করেছে তার সরকার। ধীরে ধীরে পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে।’
এএআর/