গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আগে অন্য দুটি স্থানে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করেছিল নব্য জেএমবির সদস্যরা। সেই জায়গাগুলো রেকিও করা হয়েছিল। তবে মারজান একদিন হলি আর্টিজান বেকারিতে ঘুরে এসে জেএমবির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড তামিমকে জানায়, হামলার জন্য সে হলি আর্টিজানকে নির্বাচিত করেছে ।
মারজানের যুক্তি ছিল, হলি আর্টিজানে হামলা করা হলে একসঙ্গে অনেক বিদেশিকে হত্যা করা যাবে। পরে মারজানের পরামর্শেই অন্য টার্গেট বদল করে হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা করা হয়। পরবর্তীতে মারজানই হলি আর্টিজানে হামলার অপারেশন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
গত বছর ১ জুলাই নারকীয় হামলা চালানো হয় হলি আর্টিজানে। গুলশান হামলার তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধান ও নব্য জেএমবির নেতাদের গোপন আলাপচারিতা থেকে এসব তথ্য পেয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
গুলশান হামলার পর গত বছরের ১২ আগস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে মারজানের ছবি প্রকাশ করা হয়। তার বিষয়ে অনুসন্ধান চাওয়া হয়। এর ৪ মাস ২৪ দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সহযোগী সাদ্দামসহ নিহত হয় সে। মারজানের অবস্থানের খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে অভিযান চালিয়েছিল।
পুলিশ বলছে, গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িত আরও অন্তত দুজন জঙ্গি সদস্য, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ওরফে রাহুল এবং রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে সুভাষের বিষয়েও তারা কিছু তথ্য পেয়েছেন। শিগগিরই তাদের ধরতে অভিযান চালানো হবে।
সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম শুক্রবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মারজান ছিল গুলশান হামলার অপারেশন কমান্ডার। সে টার্গেট সিলেক্ট করার পাশাপাশি নিজেই পাঁচ হামলাকারীকে নির্বাচন এবং তাদেরকে হলি আর্টিজানে হামলার জন্য প্রস্তুত করেছিল। ’
সিটিটিসি সূত্র জানায়,মারজান বেশিরভাগ সময় নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর সঙ্গে চলাফেরা করতো । হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার সময় তারা দুজন মিরপুরের এক জঙ্গি আস্তানায় অবস্থান করছিল। সেখানে বসেই হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গি সদস্য রোহান ইমতিয়াজের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়। বিশেষ একটি যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের যে কথাবার্তা হয়েছিল, তার কিছু অংশ ফরেনসিক পরীক্ষায় উদ্ধারও করেছে সিটিটিসির কর্মকর্তারা।
সিটির কর্মকর্তারা জানান, মূলত ২০১৩ সালের শেষ দিকে উগ্রপন্থী জঙ্গি দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে মারজান। তার আপন বোন জামাই নব্য জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ সাগরের মাধ্যমে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয় সে। আগে তারা দুজনই পুরনো জেএমবির একটি অংশের হয়ে কাজ করতো। ২০১৫ সালে তারা তামিমের নেতৃত্বে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগে পড়াশুনা করলেও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ায় মারজান পড়াশুনার পাট চুকিয়ে ফেলে।
সিটিটিসির এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর পুরনো ঢাকার হোসনি দালানে হামলার কয়েকদিন পর মিরপুরের একটি আস্তানায় নব্য জেএমবির নেতারা বৈঠক করে। ওই বৈঠকেই ছোটখাটো হামলার পাশাপাশি বড় হামলার সিদ্ধান্ত হয়। পরে তামিমের নেতৃত্বে মারজানসহ অন্যরা হামলার জায়গা নির্ধারণ করতে মাঠে নামে।
ওই কর্মকর্তা জানান, গোয়েন্দা অনুসন্ধানে তারা জানতে পেরেছেন, তামিম ও মারজানসহ অন্যরা দিনের পর দিন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় ঘুরে বেরিয়েছেন। প্রথমে তারা বনানী এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে একটি বিদেশি দূতাবাসকেও টার্গেট করা হয়। তবে হলি আর্টিজান বেকারির খোঁজ পাওয়ার পর মারজান সেখানে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত দেয় । মারজানের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল তামিমসহ অন্যরা।
আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং আলিম পাশ করা মারজানের গ্রামের বাড়ি পাবনার হেমায়েতপুরের আফুরিয়ায়। তার বাবার নাম নিজাম উদ্দিন। আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ার আগে সে স্থানীয় একটি কওমি মাদ্রাসায়ও পড়েছে।
গুলশান হামলায় মারজানের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে দেওয়া এক জবানবন্দিতে তানভীর কাদেরীর ছেলে তাহরীম কাদেরী বলেছে, ‘আমরা বসুন্ধরার বাসায় ওঠার কয়েকদিন পর তামিম আঙ্কেল ও মারজান আঙ্কেল বাসায় আসে।... তামিম, চকলেট, মারজানরা বাসায় ব্যাগ নিয়ে আসে। ব্যাগে অস্ত্র ছিল।’ তাহরীমের বর্ণনায় ওই বাসাতেই গুলশান হামলায় নিহত জঙ্গিরা অবস্থান করছিল।
সিটি সূত্র জানায়, শুরু থেকেই তামিম ও মারজান সবসময় একসঙ্গে অবস্থান করতো। তামিম ঢাকা শহর খুব বেশি চিনতো না। মারজানই তাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সহযোগিতা করতো। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি আরবি ভাষাতেও দক্ষ ছিল সে। গুলশান হামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও গুলশান হামলা মামলার অভিযোগপত্রে হামলার বর্ণনায় মারজানের নাম অবশ্যই উল্লেখ থাকবে।
/এসটি/ এপিএইচ/
আরও পড়ুন:
‘বন্দুকযুদ্ধে’ নব্য জেএমবির সামরিক কমান্ডার মারজান নিহত
কোথায় ছিল মারজান?
১০ মামলার আসামি ছিল সাদ্দাম