X
সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২
ধারাবাহিক উপন্যাস

লাবণ্য দাশের চিঠি—১৫

শাহনাজ নাসরীন
১২ মার্চ ২০২৫, ১৬:০২আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৫, ১৬:০২

জানলাম বনলতা সেনের চোখে যে নীড়ত্বের নিবিড় আশ্রয়ের কথা লেখা হয়েছে তা আমাকে নিয়ে লেখা নয় তোমাকে নিয়ে লেখা। ‘কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো/গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে...' মনিয়ার কথা জানার পর জানলাম পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যার যে বেতের ফলের মতো ম্লান চোখ তার সাথে পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত মনিয়াকে সহজে মেলানো যায়। আমার অবশ্য মনে হলো, ইয়েটস বা এডগার এলেন পো-এর কবিতার সাথে সবচেয়ে বেশি মেলানো যায় এই দুটি কবিতা। তা আমার কথায় কীবা যায় আসে! আশ্রয় যে নেয় সেই তো ঠিক করে কে তার আশ্রয়।

একদিকে সে বড় ঠ্যাঁটা মা বাপকেও ছাড়ে না—এ তোমরা সবাই জানো। আবার বাইরের মানুষের কাছে অতি নিরীহ, শান্ত, ছাপোষা, বিষণ্ন, এসকেপিস্ট ইত্যাদি। আমার মনে হয় তেমন ইমেজ ইচ্ছাকৃতভাবেই তৈরি করেছিল। কেন তা বলতে পারবো না। তার তো ভীষণ লুকোনোর অভ্যাসও ছিল সেটাও বা কেন! বাইরে তার নাম হয়ে গেল বিষণ্নতার কবি। কবিতায় বিষণ্নতা চেহারায় বিষণ্নতা; বিষণ্নতার আড়ালে তার রস আর কষ বাইরের কেউ দেখেনি। পরিবারের মানুষেরা দেখেছে তার শ্লেষ তার রগড় করবার ক্ষমতা। আমারই ধন্ধ লাগে বাইরে আর ভিতরে একদম ভিন্ন দুই মানুষ! তার নিজেরই একটা লাইন আছে না—বিড়াল এবং বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুরকে একইসঙ্গে হাসাতে পারে এক যুবক সেই মানুষটি হয়তো তোমার দাদাই। হাসতে পারে হাসাতে পারে খোঁচাতে পারে মজার মজার গল্প বলতে পারে, আবার এসব কিছুর বাইরে একেবারে উদাসীন, ঘোরের ভেতর ঢুকে যাওয়া অন্য এক মানুষ। একেকসময় একেকরকম মানুষ! সৎ অথচ ভানে ভরা, মিথ্যাচার করে কিন্তু মিথ্যুক তাকে কিছুতেই বলা চলে না।  বিভিন্ন সময়ে কিছু মিথ্যে প্রশংসাও করেছে অনেকের কিন্তু এমন নয় যে আর্থিক সুবিধা নেয়ার জন্য মিথ্যা বলেছে বা অন্যায় করেছে কিছু। প্রয়োজনে মিথ্যে বলতে গেলে ধরাই পরে যাবে।

আবার উল্টোচিত্রও আছে। নিজের প্রয়োজনে সামান্যতম আপস করেনি। চাকরি গেছে দু-দুবার, বাবা-মা-পিসিমাসহ পরিবারের প্রতিটি মানুষ তাকে দুষছে চাপাচাপি করছে, আমি তো সারাদিনই কাঁদছি তবু পাঞ্জাবের দুটি কলেজে চাকরির সুযোগ পেয়েও যায়নি, বাংলা ছেড়ে যাবে না বলে। সে কি তোমার জন্য? তুমি কলকাতায় ছিলে বলে? কেউ কেউ তা বলে কিন্তু আমি মানি না। রামযশ কলেজের অভিজ্ঞতা থেকেই জেনেছিল বাংলা ছাড়লে তার লেখালেখি হবে না। আমার বিশ্বাস সেজন্যেই যায়নি। কবিতাই তার সব।

আসলে কেন যে সে কী করছে তা বোঝার সাধ্য আমার বা আর কারোরই ছিল না, তার নিজের কাছেও কোনো ব্যাখ্যা ছিল কিনা আমার সন্দেহ আছে। মৃত্যুটাও দেখো কেমন রহস্যে আবৃত করে রেখে গেলো। কত আগে লিখেছিল ‘আট বছর আগের একদিন’ অথচ মারা যাওয়ার পরে মৃত্যু নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। অ্যক্সিডেন্ট, আত্মহত্যা নাকি হত্যা? তাতে আত্মহত্যা জয়ী হলো। এরপর কেবলই কেন কেন আর কেন। শুরু হলো কারণ খোঁজা। প্রথম ভিলেন আমি আর দ্বিতীয় প্রমাণ হিসেবে ভোট পেলো আট বছর আগের একদিন—

জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;

না আমি নিষ্কৃতি পাইনি। অন্তর্গত রক্তের ভিতরের বিপন্ন বিস্ময় ক্লান্ত করে তিনবার করে বলার পরেও তুমি আর তোমার মতো অনেক মানুষই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে, যদিও আগের স্তবকেই আছে—

শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,
সময়ের উর্দ্ধতনে উঠে এসে বধূ
মধু—আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;

আমার মেধা আর মননের প্রশংসা তো তোমার দাদাও বহুবার করেছে, আমার যোগ্যতা আছে সম্ভাবনা আছে বলতো, মুগ্ধতা প্রকাশ করেছে অনেকবার।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে খুব ভুলে যেতো, রেগে যেতো; জীবনটার ওপর দিয়ে কম ঝড় তো যায়নি। শারীরিক মানসিক টানাপড়েন আর নির্দয় কলকাতায় উদ্বাস্তুর জীবন তাকে বিমর্ষ, অবসাদগ্রস্ত করছিল। আর জন্মগতভাবেও এই সমাজের পরিমাপে মানসিকভাবে খুব সুস্থ সে ছিল না, যার লক্ষণ কিছুটা দেখা যেতো মাঝে মাঝে। সে যাই হোক মৃত্যুর আগে পর পর দু’দিন নাকি ভেবুল ঠাকুরপো’র বাসায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছে, জিজ্ঞেস করেছে তাদের বাড়ির সবাই ঠিক আছে কিনা, সেই এলাকায় কে নাকি মারা গেছে ট্রাম এক্সিডেন্টে, শুনে এসেছে সে, তারা কিছু জানে কিনা সে কথাও জিজ্ঞেস করেছে। এও এক রহস্য সবার কাছে। আর এই ঘটনার কারণেই আত্মহত্যা একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব পেয়েছে।

ডায়াবেটিসের জন্য সে প্রতিদিন হাঁটতো এতো তার বাঁচারই আকাঙ্ক্ষা? চুল পড়ে যাচ্ছে বলেও কত দুশ্চিন্তা; কী খাবে কী মাখবে কতো সব পরামর্শ সুবোধ বাবুর সাথে! মজা করেই করেছে। উচ্চমার্গীয় লেখক সঙ্গ ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের সাথেই তখন পর্যন্ত তার সহজ সম্পর্ক ছিল। সেই মানুষ আত্মহত্যা করলো! সেদিন হাঁটাহাঁটি শেষ করে বাড়ি ফিরছিল, দুটি ডাবও নাকি কিনেছিল এতসব করে ট্রামের নীচে যাওয়ার দরকারটা কী! সেখানে যারা ছিল তারাও বলেছে প্রথমবার জ্ঞান ফেরার পর বাড়ি ফিরতেই চেয়েছিল। উঠে দাঁড়িয়ে আবার নাকি পড়ে যায়, তখন হাসপাতালে নিয়ে যান তারা। তাহলে কী বলবো? হঠাৎ সিদ্ধান্ত? নাকি অন্যমনস্কতা? অন্যমনস্ক সে থাকতো তা সত্যি। সেই ছোটবেলা থেকে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যেতো আর কথার খেই হারিয়ে ফেলতো প্রায়ই, যারা বুঝতে পারতো না তারা হাসাহাসি করতো। রাস্তায় হাঁটার সময়ও কোনদিকে লক্ষ্য করতো না, কেউ ডাকলেও শুনতে পেতো না। একবার তো নাকি এক গরু শিং ঢুকিয়ে দিচ্ছিল প্রায়, একটি ছেলে ছুটে এসে টান মেরে সরায় তাকে। সারাক্ষণ মাথায় কবিতা থাকলে রাস্তাঘাটে মনোযোগ রাখা যায় না সবসময়। আর ট্রাম তো বরিশালে দেখেনি, কলকাতাতেই ট্রামের সাথে পরিচয়। ট্রামগুলোকে সে ভয় পায় এগুলোর গতিবিধি ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না এরকম নাকি বলেছে অনেকের কাছে। ট্রামের দিকে তাকিয়ে ভয়ংকর সব উপমা মনে আসতো তার।

সে সময় তার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে আর জানো তো খেতে কেমন ভালোবাসতো, ডায়াবেটিস একেবারেই নিয়ন্ত্রণে থাকতো না। দ্রুতই চোখগুলো নষ্ট হচ্ছিল। চশমাতেও কাজ হচ্ছিল না খুবই কম দেখতো। ছানি পরীক্ষা করানো দরকার ছিল আমার তো মনে হয় এটাই সমস্যা আরও বাড়িয়েছিল। শেষের দিকে সে একা হাঁটতে ভয় পেতো, সবসময় প্রতিবেশী সুবোধ বাবুকে সাথে নিয়ে হাঁটতো। সেদিনও তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে তিনি অসুস্থ ছিলেন বলেই একা গেছে। আত্মহত্যা করার প্ল্যান থাকলে সুবোধ বাবুকে ডাকতে যাবে কেন! নাকি একা হয়ে যাওয়ার সুযোগের সদ্ব্যবহার? তাহলে এত হাঁটাহাঁটি কেন? শুরুতেই পারা যেত না? কী মনে হয় তোমার?

তবে একটা কথা কি জানো? অনেক অনেকদিন পরে যখন তোমার দাদার ট্রাংক ভর্তি লেখা আবিষ্কৃত হয়েছে, ডায়েরিগুলো পড়া হচ্ছে তখন একেবারে শেষের দিকে আমাকে খুন করার জন্য তোমার দাদা ভাড়াটে খুনি (ডায়েরিতে সুপারি লিখেছে) লাগানোর পরিকল্পনা করেছিল সে কথা ডায়েরিতে লিখেছে। একবার নয় কয়েকবার করবে কী করবে না এরকম ভাবনার কথাও ডায়েরিতে ছিল। এর সাক্ষী তিনজন। ভূমেন্দ্র, নীরেন্দ্র আর জহর। তারা হয়তো স্বীকার করবে না। কারণ তারা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিল এ কথা প্রকাশ করা যাবে না, কবি ছোট হয়ে যাবেন। সুতরাং প্রকাশ হয়নি। এই হচ্ছে ভক্তদের কাণ্ড। এখন আমি যদি বলি তোমার দাদা আমার মৃত্যুর খবর নিতেই পর পর দু-দিন নিনিদের বাড়ি গিয়েছিল? এতো বিশ্বাস করাতেও পারি এই বলে যে, তিনি ভাড়াটে উচ্ছেদ করতে গুন্ডার খোঁজ করেছিলেন এ কথা সাহিত্যমহলের সকলেই জানে। তাছাড়া সপরিবারে আত্মহত্যার নানারকম প্ল্যানের কথা তো ডায়েরিতে লিখেছেই বিস্তারিত। কাজেই আমার মতো দজ্জাল বউকে মারতে সুপারি খুঁজেছে এও সত্য হতেই পারে তাই না? এতে ভেতরে ভেতরে কেমন বুনো রাগ সে পুষতো তা কি আন্দাজ করা যায় না? তার চাহিদামতো শরীর পেতো না বলে আমার ওপর ভয়ংকর রাগ তো তার ছিলোই।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রেক্ষাপটই ভাষা ও শৈলী নির্ধারণ করে : রফিকুজ্জামান রণি
প্রেক্ষাপটই ভাষা ও শৈলী নির্ধারণ করে : রফিকুজ্জামান রণি
এবারের পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক নয়, কার্যকর করতে চাই: আইজিপি
এবারের পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক নয়, কার্যকর করতে চাই: আইজিপি
ধর্ষণের অভিযোগে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু
ধর্ষণের অভিযোগে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
সর্বাধিক পঠিত
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
রিজার্ভ আরও বাড়লো
রিজার্ভ আরও বাড়লো
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’