কলকাতায় এত অনটন আর অসুস্থতার মধ্যেও আমি ভালো বোধ করেছি, শক্তি অনুভব করেছি। আমিও চাকরি করব সংসারে সচ্ছলতা আসবে বাচ্চারা ভালো খাবে পরবে এরকম একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। তোমার দাদার কল্যাণেই অর্থাৎ তার এক বন্ধুর মাধ্যমে একটা স্কুলে লিভ ভেকেন্সিতে এক বছরের জন্য মাস্টারি করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখানেই শুনলাম বি.টি করলে স্থায়ীভাবে স্কুলে চাকরির সুযোগ পাওয়া যাবে তাই অনেকটা জোর করেই বি.টি-তে ভর্তি হয়েছি। তোমার দাদা খুব বাধা দিয়েছিল আমি অসুস্থ বলে, আর সত্যি সত্যিই জেদ করে যখন ভর্তি হলাম অসুস্থ শরীর ধকল নিতে পারছিল না। অসুস্থ হয়ে চারমাস বিছানায় পড়েছিলাম। তোমার দাদা তো ভাবেইনি পাশ করব। আগেভাগেই সান্ত্বনা দিতে শুরু করেছিল। আমি অবশ্য তোমার দাদাকে বিস্মিত করে আবারও পাশ করেছি। পরে তো চাকরিও পেলাম আর চাকরি করে সংসার আমিই টেনেছি অনেকটা।
আমাকে তো চাকরির পরও রান্নাবান্না করা, রঞ্জুকে পড়ানো, সংসারের সব কাজ করতে হতো। ঘরদোর সুন্দর করে গুছিয়ে এমন ঝকঝকে তকতকে করে রাখতাম যে দৈন্যের চেয়ে আমার পরিচ্ছন্ন রুচিবোধটাই চোখে পড়তো সকলের। বাড়িতে যারাই আসতো সেই মুগ্ধতাই প্রকাশ করতো বারবার করে। তোমার দাদার চাকর রাখার সামর্থ্য ছিল না কিন্তু তার বন্ধুরা ঝাঁটা হাতে আমাকে দেখে ফেলায় খুবই সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। আমার সাথে এমন রেগে গিয়েছিল কী বলব! যেন তার বন্ধুরা জানতো না তার অনটনের কথা। আমাকে যে একা একা এত কাজ করতে হয় এটা বিষয় না সমস্যা হচ্ছে বন্ধুরা দেখলে।
কলকাতায় এসে সম্পর্কের ফাঁকটা বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সংসারের ভেতর আমরা যেন পজিটিভ আর নেগেটিভ চার্জের দুটি বিপরীতধর্মী ব্যাটারি। তোমার দাদা আবারও বেকার হলো। আবার ভাই বোনের সাহায্য নিয়ে চলা, প্রতিদিনকার টানাপড়েন। বিয়ের পরের দিনগুলোর স্মৃতি ভয় পাইয়ে দিলো আমায়। কলকাতার বেকারত্বের দিনগুলো আরও ভয়ংকর চেহারা নিয়ে আমাদের গ্রাস করলো। বরিশালে মাথার ওপর অনেকগুলি ছায়া ছিল। বিশাল বটবৃক্ষের মতো ছিলেন শ্বশুর মশাই। পাশাপাশি শাশুড়ি, পিসিমা, কাকাবাবু, মামাবাবু সবাই মিলে একরকমের সাহস জোগাতেন সহযোগিতা করতেন। সেটা বিশেষভাবে মন ভালো রাখতো তোমার দাদার। কিন্তু সেই যুদ্ধপীড়িত, দাঙ্গাপীড়িত, উদ্বাস্তুর ঢলে বিধ্বস্ত ভঙ্গুর কলকাতায় আমরা একেবারে কোণঠাসা হয়ে গেলাম। তুমি দেখেছ তো।
কলকাতায় আমাদের ল্যান্সডাউনের বাড়িতে যখন আসতে আমার সাথেই গল্প করতে সারাক্ষণ। আমার প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায় অবিচারগুলো তুমি বুঝতে পারো এমনি ভাবতাম আমি। বেশ সহানুভূতি দেখাতে তো আমার প্রতি! তোমার মিলুদার প্রতি তখন বেশ তাচ্ছিল্যই দেখেছি তোমার। সেটা যে তোমার অভিনয় তা আর বুঝে উঠতে পারিনি। নাকি তাই সত্যি ছিল? সত্যিই আমাদের অবস্থা দেখে তাচ্ছিল্যই করতে তাকে তাই না? তার জন্যই যে আমাদের এই অবস্থা আর তাকে প্রত্যাখ্যান করে তুমি যে বেশ বেঁচে গিয়েছ এটা ভেবেও ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাওনি?
আমার প্রতি তোমার এমন বিষদৃষ্টি ছিল আমি বুঝতেই পারিনি! তোমাকে সন্দেহ করিনি কখনো। আসলে এসব দিকে ফিরে তাকাইনি কখনো, সময়ও পাইনি মনও তেমন কুচুটে ছিল না। একটু সরল সোজাই ছিলাম আসলে। মা ছিল না, অকৃতদার জ্যাঠামশাইয়ের অভিভাবকত্ব আর হোস্টেলে থেকে পড়াশোনার ফলে সাংসারিক বুদ্ধি পাকেনি তেমন। স্বভাবটাও বিপ্লবী। যৌবনারম্ভে দেশের জন্য জীবন দেয়ার স্বপ্ন যে দেখে সে তো আসলে রোমান্টিক, কূটচালের পথে সে হাঁটবে না তাই তো স্বাভাবিক।
একটা সময় আমাদের সম্পর্ক এমন তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল যে দিনের পর দিন আমরা গল্প তো দূর প্রয়োজনের বাইরে একটা কথা বলতাম না। তবে এটা যে শুধু আমার বিরাগের জন্য হলো তা না। তোমার দাদা তো সংসারকেন্দ্রিক মানুষই ছিল না আসলে। স্ত্রী সন্তানকে কেন্দ্র করে যতটা না চলতো তার চেয়ে অনেক বেশি সময় কাটতো লেখার ঘোরের মধ্যে, তখন সে একেবারে অন্য মানুষ। একজনের স্মৃতিচারণে শুনেছিলাম সে নাকি পার্কে হাঁটার সময় একটি বাচ্চা পড়ে গিয়ে বেশ ব্যথা পেয়ে কাঁদছিল তাতে তোমার দাদা বিরক্ত হয়ে বলেছেন “অসহ্য, শহরে দু’দণ্ডও শান্তি নেই”। সচেতন সময়ের কবির সাথে এই চিত্র মেলানো অসম্ভব। সচেতন সময়ে সে অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ কিন্তু ঘোরের সময় প্রায় অমানুষ!
নিশ্চিতভাবে জানি তুমি বিশ্বাস করছো না। এই মানুষকে তুমি দেখোনি চেনো না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা আছে আমি বিশ্বাস করি। সারারাত হাঁপানিতে কষ্ট পাচ্ছি ঘুমাতে পারি না অথচ তোমার দাদা একবার পাশে এসে বসে না একটা ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে না। এমন না যে ঘুমাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে বসে আছে লেখার টেবিলে। লেখার টেবিলে সে ঘোরের মধ্যেই থাকতো পাশেই কী ঘটছে খবরই থাকতো না। মজার কথা হলো কলেজ থেকে সে ছুটি নিয়েছিল আমি অসুস্থ আমার দেখাশোনা করতে হবে, তাই তার পক্ষে কলেজে আসা সম্ভব না বলে। তারপরেও কী করে পারে এমন? হ্যাঁ সে পারতো। আরও অনেক কিছুই পারতো। আমি রাগ করলে চেঁচাতাম ঝগড়া করতাম কিন্তু সে রাগ প্রকাশ না করে একটি কটু কথা না বলে নির্মমভাবে দূরে ছুড়ে দিতে জানতো। এমনকি ভালো ভালো কথা বলার সময়েও ভেতরের গভীর বিরাগ বলো বা ঘৃণা লুকিয়ে রাখতে পারতো। এরকম অবহেলা ঘটলে তোমার কী প্রতিক্রিয়া হতো শোভনা? তোমার ভাষ্যমতো এতো খারাপই যদি হতাম চাকরি-বাকরি বাদ দিয়ে সারাদিন টেবিলে বসে থাকতে পারতো না বুঝলে?
শুধু তো আমি নই বেশিরভাগ মানুষের সাথেই তার মিলমিশ হয়নি। কেন হয়নি বলো তো? কারণ বেশিরভাগের মধ্যে সে পড়ে না। আমি থেকেছি তার সাথে আমি জানি, তাঁর কবিতায় যতই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ থাক না কেন সংসারের বড় ছোট দুঃখ-বেদনায় তাকে খুব কাতর হতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অথবা হয়ত হতো, এখন বুঝি সে পর্যবেক্ষণ করতো, অনুভব করতো তবে আমাদের মতো করে প্রকাশ করতো না। সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে তার লেখায়। সেরকম পরিস্থিতি গল্প বা উপন্যাসে যখন এনেছে তখন চরিত্রগুলোর আচরণে বুঝতে পারা গেছে তার প্রতিক্রিয়া। এমনকি পরের দিকে কবিতায়ও ক্ষয়িষ্ণু সমাজের মনস্তত্ত্ব নিখুঁতভাবে লিখেছে। তবু কেন তাকে পলায়নপর বলা হয়েছে আমি বুঝি না! সময়ের ভুক্তভোগী তো সে-ই সবচেয়ে বেশি। সব হারিয়ে নিঃস্ব রিক্ত হয়েছে কিন্তু অন্যদের মতো হৈচৈ সে করেনি। স্লোগান সে দেয়নি, না জীবনে না কবিতায়। ‘এইসব দিনরাত্রি’ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি দেখো—
মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো
এইখানে
পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।
তাদের সম্রাট নেই, সেনাপতি নেই;
তাদের হৃদয়ে কোনো সভাপতি নেই;
শরীর বিবশ হ’লে অবশেষে ট্রেড ইউনিয়নের
কংগ্রেসের মতো কোনো আশা হতাশার
কোলাহল নেই।
...
ইতিহাস অর্ধসত্যে কামাচ্ছন্ন এখনো কালের কিনারায়
...
চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধভীড়—অলীক প্রয়াণ।
মন্বন্তর শেষ হলে পুনরায় নব মন্বন্তর; যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;
মানুষের লালসার শেষ নেই;
উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ
অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ
অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয়সাধ
নেই।...
আরেকটি কবিতা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে—‘অদ্ভুত আঁধার এক’
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
অজস্র কবিতা আমি দিনের পর দিন পড়েছি আর ভেবেছি কেন মানুষ তার সমাজ সচেতনতা, রাজনৈতিক সচেতনতা, তার দর্শন বুঝতে পারলো না। কেন তাকে ‘স্বভাব কবি’ কেন শুধু প্রকৃতির, হেমন্তের, নির্জনতার ইত্যাদি ইত্যাদি বলা হলো!