সে যাইহোক, বরিশাল আমার একেবারেই ভালো লাগেনি, তাই এত বছর পরেও কলকাতা যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার সাথে সাথে যাওয়ার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। তোমার দাদা ছিল দোটানায়। একদিকে তার কাব্যখ্যাতি বাড়ছে, কলকাতা থেকে ডাক আসে প্রায়ই, বন্ধুবান্ধব আর ভক্তও হয়েছে অনেক। কলকাতায় থাকতে পারলে লেখার চর্চা আরও বাড়ানো যাবে, এদিকে ছাত্র পড়ানোটাও একঘেয়ে লাগছে। তাই একদিন আমার শাশুড়িকে সার্বিক পরিস্থিতির কথা বলে কলকাতা চলে যাওয়ার কথা তুললো। আমার শাশুড়ি কিন্তু রাজি হলেন না। তার ছেলের স্বভাব তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি প্রথমেই চাকরির কথা তুললেন। তোমার দাদা তো স্বপ্নবিলাসী বললেন, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু তার মা পোড় খাওয়া মানুষ, তাছাড়া বরিশালের বাড়ি এভাবে খালি করে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি সায় দিতে পারেননি। বেকারত্বের অভিশাপে আমার জীবনও পুড়ে ছাই হয়েছিল, তবু আমি কিছুতেই বরিশালে থাকতে চাইছিলাম না। আমার হাজারো চাপাচাপিতে অবশ্য তোমার দাদার মন পাল্টাত না। আসলে ততদিনে তারও আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, কারণ কলকাতায় সাহিত্য নিয়ে কাজ করার সম্ভাবনা হয়েছিল এবং অধ্যাপনা করতে তার আর ভালো লাগছিল না বলে। কিন্তু আমার শাশুড়ির অনিচ্ছায় দোটানা শুরু হলো আর এই দোটানায় আরও কিছুদিন গেল।
বরিশাল থেকে যখন কলকাতায় গেলাম নিজের ট্রাঙ্কগুলো ছাড়া আর তেমন কিছুই নিতে দেয়নি। তারপরেও আফসোস করেছে অনেক লেখাই রয়ে গেল বলে। দেখ শোভনা, এখানেও তোমার দাদার দ্বিমুখী আচরণ। একদিকে আমাকে কিছু গোছাতে দিচ্ছে না যে কলেজ থেকে দু-মাসের ছুটি নিয়েছে, দু-মাস পরেই তো আবার চলে আসব। অন্যদিকে তার লেখা যতটা সম্ভব নিচ্ছে আর যতটা নিতে পারল না তার জন্য দুশ্চিন্তা করছে। এ নিয়ে আমি অবশ্য তুলকালাম বাঁধাইনি। আমি তখন খুশিতে টইটম্বুর, শুধু এটুকু ভেবে যে, এতদিনে আমি শহরের মুখ দেখব, আমার শৃঙ্খল ঘুচবে। এই গ্রাম্যতা থেকে মুক্ত হয়ে আমি আমার প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারব, স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারব। আমার বাচ্চাদেরকে ভালো পরিবেশে আধুনিক করে গড়ে তুলতে পারব।
কলকাতায় গিয়ে অবশ্য স্বপ্নভঙ্গ-ই হয়েছিল। কী দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল পরিস্থিতি! অনেকদিন থেকেই তো নানারকম কথা ভেসে বেড়াচ্ছিল বাতাসে, তবু আমরা এরকম একটি দেশভাগের জন্য প্রস্তুত হতে পারিনি! আমরা তো ভেবেছিলাম কলকাতায় আমরা বাস করব কিন্তু বরিশাল আমাদের আশ্রয় হয়েই থাকবে। আগে যেমন তোমার দাদা কলকাতায় যেয়ে থাকত আবার কিছুদিন পর পর বরিশাল এসে নিজেকে তরতাজা করে নিত বরিশালের শুশ্রূষায়। কিন্তু তা তো হলো না। হঠাৎ আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম। উদ্বাস্তু হয়ে একেবারে পথে বসলাম বলা যায়। আবার সেই বেকারত্বের অভিশাপ, ধার-দেনা, আত্মীয়-বন্ধুদের কাছে সাহায্যের আবেদন, ঠাকুরপোর বাড়িতে আশ্রয় নেয়া, এমনকি বয়সে অনেক ছোট যে ননদ সুচরিতা বাড়িতে সে খুকী, সেও অর্থ সাহায্য করতে লাগল নিয়মিত। এইসব করুণা তোমার দাদা খুব সহজেই নিত, কিন্তু আমার কী যে অপমান লাগত, এখনো মনে পড়লে শিউরে ওঠি! সেই বিয়ের পর থেকে কখনো শ্বশুর, কখনো দেওর এরপর ননদ, জা বিভিন্ন চেহারায় এসব দান হজম করা যেন আমার নিয়তি! এভাবেই চলতে লাগল জীবন। নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক লাগত আমার, কোথায় হারিয়ে গেছে সেই রূপসী, অহংকারে ঝলমল, তেজী মেয়েটা! আমি যেন মান-অপমানের বোধহীন একটা কুকুরের জীবন যাপন করছিলাম! এই জীবনযাপন ভয়াবহ অসুখ হয়ে এলো আমার জীবনে। শরীর তো ভেঙেছিল মঞ্জুর জন্মের সময়েই, এবারে বুকে ভয়ানক ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট। ডাক্তারবাবু অবাক হয়ে গেলেন এই বয়সে আমার এই রোগ কেন হয়েছে। এরপর তিনিই বের করলেন, মনের রোগ জটিল হয়ে আক্রান্ত করেছে শরীরকে। এসব কিন্তু তুমি জানতে, তবু বলেছ আমি ভাজাপোড়া করেছি তোমার দাদাকে, ভাজাপোড়া যে আমিও হয়েছি তোমাদের পর্দা পড়া চোখে তা ধরা পড়েনি!
তোমার দাদা তো এক বছর যায় দু-বছর যায় চাকরি পায়নি বরং বলা ভালো এই অজুহাত সেই অজুহাতে বাদ দিয়েছে। ঠাকুরপো দিল্লীতে একটা চাকরি ঠিক করলেন, গেলেই হয়ে যাবে তো গেল না। খড়গপুর, বরিসা আরও কয়েক জায়গায় একই ঘটনা। কতো যে ঠেলেছি, নিজের অসুস্থতা সত্ত্বেও বলেছি যেতে আমি সামলে নেব, ছেলেমেয়ের কথা ভেবে হলেও যেতে বলেছি কিন্তু যায়নি, আর গেলেও এক দুমাসের মধ্যে চলে এসেছে বা চাকরি গেছে। চাকরি করার মানুষই ছিল না সে। স্বরাজ পত্রিকার চাকরিটাও ছেড়েছে অথচ ওই চাকরিটা বজায় রাখলে সংসারটা হালে পানি পায়, আমাদের দুর্গতি কমে তবু প্রতিদিন স্বরাজের চাকরি ছেড়ে দিতে চাইত। শেষে তো ছাড়ল-ই। ওটা আর্থিক দুর্গতিতে ভুগছে বলল, তবে তা না হলেও সে ছাড়ত-ই আমি হলফ করে বলতে পারি।
‘পৃথিবীতে নেই কোন বিশুদ্ধ চাকুরি'—শুনতে কতো ভালো এই পঙক্তি কিন্তু বিশুদ্ধতার অভাবে চাকরি না করে কে কবে থেকেছে বল তো? তুমি পেরেছ বা তোমার স্বামী? তোমার স্বামী যদি তাই করত, তুমি কী করতে জানতে ইচ্ছে হয় শোভনা। প্রশ্নের উত্তরে তুমি হয়ত মহত্ত্বর, একটা কিছু সহজেই বলে দেবে কিন্তু তা তো সত্য বাক্য হবে না। তোমার দাদার ‘কবিতা কবিতা' বাতিকের জন্যই তো তুমি পালিয়েছিলে। কবিতা লিখে যে কিছু হয় না তা জানতে তুমি। সে তোমাকে বই উৎসর্গ করেছে, তার মূল্য তোমার কাছে ছিল না। তোমাকে সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখেছে সেও তুমি রাখোনি। ছি! শোভনা কবির চিঠি কেউ হারাতে পারে! এগুলো বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ হতো। তোমার কাছে কতটা গুরুত্বহীন সে ছিল তা সে জানতেও পারল না, আহা!
বিয়ের পর পর তার বেকারত্বের যাতাকলে সর্বানন্দ ভবনের বিশাল পরিবার ধুঁকছে, আমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক তলানিতে, আমি আর মঞ্জু অসুস্থতায়, অপুষ্টিতে মরো মরো; সবাই আমরা তাকে দায়ী করছি তার সমালোচনা করছি অথচ তোমার দাদা দুটি কথা বলেনি কখনো। ওর মধ্যেই তার জন্মদিন এলো, আগের দিন তাকে অনেক কঠিন কথা বলা হয়েছিল তাই বাড়ির পরিবেশ ছিল থমথমে। আমার শাশুড়ি সকালে প্রতিবারের মতোই পায়েস রান্না করলেন, ছেলেকে দিলেন খেতে, ছেলেও বেশ খুশি হয়েই তারিয়ে তারিয়ে পুরো পায়েস খেলো! আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম! এরকম পরিস্থিতিতে আমি হয়ত না খেয়ে মরার সিদ্ধান্ত নিতাম বা গলায় দড়ি দিতে ছুটতাম! আমার মনে হয়েছিল একী মানুষ! গণ্ডারের চামড়া নাকি এর শরীরে! একসময় সজনীকান্তের দল তাকে গণ্ডার কবি বলেছিল, তারাও বোধহয় আমারই মতো জানত না যে, খুব বড় খুব গভীর কিছুতে যার নজর, সে জাগতিক অনেককিছু উপেক্ষা করতে পারে বা করে। সাধারণরাই অল্প শোকে কাতর হয়।
বিয়ের পর পর তোমার দাদার কিছুটা আগ্রহ ছিল আমাকে কবিতা, গল্প শোনানোর। কিন্তু তখন আমার একমাত্র সঙ্গী কান্না। জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়ার দুঃখে এমন রাগ হতো তার ওপর আমার, যে তার কবিতা শুনব কী উল্টে তাচ্ছিল্য দেখাতাম। আর কবিতার জন্যই যে তার কাজের স্পৃহা নেই উদ্যম নেই সে কথা বলতাম। তোমার দাদার নীরবতা আমার আক্রোশ আরও বাড়িয়ে দিতে লাগল, আরও বেশি করে আমার একটা ভুল চেহারা তাকে দেখিয়ে নিষ্ঠুর আনন্দ পেতে লাগলাম। ধীরে ধীরে সেও তার কবিতা নিয়ে দূরে সরে গেল, আর কাব্যবোধ নেই বলে ভিতরে ভিতরে আমার প্রতি তার তাচ্ছিল্যের সীমা রইল না।