X
সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২
ধারাবাহিক উপন্যাস

লাবণ্য দাশের চিঠি ।। পর্ব—নয়

শাহনাজ নাসরীন
২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:১৪আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:১৪

এই একটি মানুষ, সমকালের কবিরা যাকে বুঝতে পারেনি, বুদ্ধদেব বাবু পর্যন্ত যাকে বলেছেন ‘আকস্মিক’। অর্থাৎ কিনা শেকড় নেই, ধারাবাহিকতা নেই। মেলাতে পারছেন না কারও সাথে, তাই ধারণা করছেন ভবিষ্যতও নেই। এরকম সৃষ্টিছাড়া কবিকে আমি কী করে বুঝতে পারবো? আমার বয়সটাই বা কত ছিল! শুধু কবি হিসেবেই তো নয়, এই মানুষটিকেও কেউ বুঝতে পারেনি, এতোটাই দূরে থাকতো সে সম্পর্ক থেকে—ভিড়, আড্ডা সবকিছু থেকে—কাছে থাকলেও কি সম্ভব ছিল বোঝা, কী জানি আমি কি বুঝতে পেরেছি? পারিনি। পারিনি যে তাও তখন বুঝিনি।

অবাক লাগে ভাবতে যে ওই বেকার সময়েই তার লেখায় আবার জোয়ার এসেছিল। দীর্ঘ সময় পর কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য লেখাও শুরু করেছিল। অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলি গল্প আর উপন্যাস লিখে ফেলা হলো। যদিও সেগুলো ট্রাঙ্কবন্দী হয়ে পড়ে ছিল অনেক কাল। আমি দেখছি, গল্প উপন্যাসগুলোতে বারবারই একটি ব্যর্থ প্রেম, অসহায় স্বামী, পারিবারিক চাপ, সমাজ বাস্তবতা ইত্যাদি নিয়ে তার গভীর আলোচনা ঘুরেফিরে এসেছে। সংসারের অসারতাও এসেছে। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত, যাকে বিয়ে করবে তার সম্পর্কে আগ্রহের নিদারুণ অভাব সবই আছে। কিন্তু বেশ কিছু গল্পে আমি সাংসারিক ব্যর্থতার জন্য নায়কের অসারতা, অপারগতা, অপ্রেম, অনিচ্ছা দেখি। নায়কের ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণাকাতরতা দেখি, অর্থনৈতিক অসফলতা, বন্ধুদের নিষ্ঠুরতা দেখি। কই তার সাথে মিলিয়ে—তোমার দাদার সাংসারিক অনুপযুক্ততার তেমন আলোচনা তো চোখে পড়ে না! তার সে সময়ের অনেক গল্পে স্ত্রীর আত্মহত্যা, বাচ্চা হতে গিয়ে মৃত্যু এরকম দৃশ্য আছে। আমার শ্বশুরকে নাকি ‘সে কী চায়’ এরকম প্রশ্নের উত্তরে সে নাকি বলেওছিল, আবার যদি ব্যাচেলর হয়ে যেতে পারতো। আমার শাশুড়ি তার ছেলের লেখা নিয়ে যেমন গর্বিত ছিলেন, দায়িত্ব থেকে তার পলায়নপরতার জন্য তেমনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। সবকিছুতে তিনি নির্ভর করতেন ঠাকুরপো আর নিনির ওপর। সে সময় আমার সাথে কিন্তু তোমার দাদা সামান্যতম খারাপ ব্যবহার করেনি। বরং আমি যত যাই করতাম সে হাসতো বা আমাকে মানানোর চেষ্টা করতো। তবে ভেতরে ভেতরে হয়তো অতিষ্ঠ বোধ করতো, নইলে আবার ব্যাচেলর হবার আকাঙ্ক্ষা জাগবে কেন।

সে সময় একদিন বরিশালের বাড়িতে আমাকে গ্রেফতার করতে পুলিশ এসেছিল। সবাই তো হতভম্ব, তোমার দাদা বার বার বলছে ‘না আপনারা ভুল করছেন, ওর কেন বিপ্লবের সাথে সম্পর্ক থাকবে’। পুলিশ আমার ঘর সার্চ করার নামে, তার কবিতার খাতাগুলো তছনছ করেছিল, তবে শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়েই দিয়েছিল, কিছুটা আমার উপস্থিত বুদ্ধির জন্য। তার চেয়েও বেশি, তোমার দাদার কবিতার বই ‘ঝরা পালক’ এর জন্য। সেই দলে যিনি অফিসার, বইটি তিনি টেবিলে বসে বসে পড়ছিলেন, এরপর চেয়ে নিয়ে গেছেন। এতটাই মুগ্ধ হয়েছেন যার বইয়ে, তার বউকে আর কী করে নিয়ে যান! তারা যাওয়ার পরে, ঝড় বয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। সেদিন তোমার দাদার প্রতি বেশ শ্রদ্ধাবোধ এসেছিল যে অন্যেরা আমার প্রতি অত্যন্ত অসহিষ্ণু হলেও, সে কোনো কটু কথা বলেনি বা বিন্দুমাত্র বিরক্ত হয়নি। অথচ ক্ষতি তারই সবচেয়ে বেশি হয়েছিল। তার প্রিয় কবিতার খাতাগুলো একেবারে নষ্ট করে ফেলেছিল পুলিশের দল। এতো বিরাগের পরও কবিতার খাতাগুলোর জন্য খুবই খারাপ লেগেছিল আমার। দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু তোমার দাদা অবাক করেছে। অন্যদের মতো রাগ বা বিরক্তি তো দূর, বলেছে, আমি যে আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে আলাদা, আমি দেশের কথা চিন্তা করি, তা জেনে ওর বরং ভালো লেগেছে। আমার প্রতি তার নাকি শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছে।

গল্প উপন্যাসগুলোতে দক্ষ হাতে, চাঁছাছোলা ভাষায় মন্বন্তর, দাঙ্গা, অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধোত্তর জীবন বাস্তবতা এমনভাবে এসেছে যে, লোকে তার গল্প উপন্যাস দিয়ে তার জীবনবৃত্তান্ত লিখে ফেললো! সত্যি যে গল্পে সে নিজের জীবন আর পরিবেশগত বাস্তবতার এমন নিখুঁত মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়েছিল, সেই পরিবেশে গল্পের চরিত্রগুলো যা বলছিল করছিল, মনে হচ্ছিল সব যেন সত্যি ঘটনা। তারাশঙ্কর, মানিক বা বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখাগুলো দেখো, জীবনের সত্য গল্পই তো, প্রতিটি গল্প বা উপন্যাস জীবনেরই টুকরো গল্প। তবু পড়লে বোঝাই যায়, এ তাদেরও জীবন নয়, তারা একটি গল্প বলছেন, প্রত্যেকেরই। তোমার দাদার গল্প উপন্যাস কেন তবে তার আত্মজীবনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলো? এটা কি তাহলে তার গল্প বলার ধরনের জন্য? আমি তো সাহিত্যবোদ্ধা নই, তবে তার চলে যাওয়ার পর বার বার করে, সবার লেখার সাথে মিলিয়ে পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিম থেকে তোমার দাদার সমসাময়িক বিখ্যাত সব লেখকই একই ধাঁচে লিখেছেন, শুধু তোমার দাদার লেখা ছিল ভিন্ন ঘরানার, যা অন্যেরা তখন বুঝতে পারতো না। কী জানি! ওই কারণেই সে তার গদ্য লুকিয়ে রেখেছিল কিনা।

রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম আর শরৎচন্দ্রের পর, তখন যারা ভালো লিখছিলেন যেমন, মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে বিখ্যাত হচ্ছিলেন। এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও বুদ্ধদেব বসু, জগদীশ গুপ্ত বেশ নাম করেছেন তখন। তোমার দাদা কিন্তু তাদের লেখার সমালোচনা করেছেন। এ কাজ কিন্তু সহজ নয়। সমকালীন বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে গভীর পাঠ না থাকলে, এতো সাহস করা সম্ভব হতো না। আর তা ছিল বলেই, নিজে তাদের চেয়ে একদম অন্যরকম লিখেছিলেন। প্রকাশ করলে মানুষ নিশ্চয়ই চমকে যেতো, একটি আলাদা ঘরানা তৈরি হতো যা একেবারেই নতুন, একেবারেই অন্যরকম আর অনেক বেশি আধুনিক। কবিতার মতো বাংলা গদ্যের বাঁক বদলেও তার নামই নিতে হতো। পদ্য গদ্যে সমান দক্ষতা দেখানো চাট্টিখানি কথা তো নয়, কিন্তু লোকটি মুখোশ পড়ে রইল, ভান করলো। তার গল্প উপন্যাস পড়লেই ধরা পড়ে, সে কতটা অন্তর্দৃষ্টি ধারণ করে। জীবনের গভীর বোধ, রাজনৈতিক সচেতনতা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, শ্লেষ, হিউমার, সুররিয়ালিজম আরও অনেক কিছুই দিনে দিনে আবিষ্কৃত হচ্ছে, অথচ তিনি কী করলেন—গোবেচারা সেজে রইলেন! 
রবীন্দ্রনাথকে ঘোষণা দিয়ে অস্বীকার করেছিলেন যে-সকল কবি, তারাও কি তোমার দাদার মতো মৌলিক হতে পেরেছিলেন? এরকম গল্প উপন্যাস লেখার কথা তখনের বাঘা বাঘা সাহিত্যিকরা জানতেনও না, জানবেনই বা কোত্থেকে, এমন মেধাবী আর বিশ্বসাহিত্য গুলে খাওয়া সাহিত্যিক ছিল নাকি আশেপাশে। অনেকের মেধা যদিবা ছিল, সাহিত্যের জন্য প্রাণপণ করবার বাসনা কারও ছিল না। সবারই ছিল দায়িত্বজ্ঞান, অর্থ উপার্জনের ভাবনা। এই যে বুদ্ধদেব লিখতেন, প্রতিভা লিখতেন, তাদের লেখা থেকে সংসারে টাকা আসতো, সমাজে সাফল্য আসতো আর তোমার দাদা লেখার জন্য চাকরি ছাড়তো অথবা বহিষ্কৃত হতো, টাকাপয়সা তো আসতোই না। অথবা চাকরি পেয়েও, এই অজুহাত সেই অজুহাতে জয়েন করতে যেতো না, বা সুযোগ পেলেই ছেড়ে দিতো। চাকরি করাটাই তার অপচয় মনে হতো। বারবার বলতো কী অপচয় বলো তো— মেধার অপচয়, সময়ের অপচয়।

আমি লেখক নই কিন্তু লেখকদের প্রতি সম্মান ছিল। তোমার দাদার প্রতি অভিযোগ থাকলেও, তার লেখা আমাদের দুঃখ দৈন্যের কারণ হলেও, বাঁধা কিন্তু দিইনি ছেড়েও যাইনি। বাচ্চাদেরকেও শিখিয়েছি তাদের বাবার লেখার সময় যেন তার ঘরে না ঢোকে বা শব্দ না করে। তা নাহলে সারাদিন টেবিলে বসে থাকতে পারতো না—পাণ্ডুলিপিতে ট্রাঙ্ক ভরে উঠত না।

তোমার দাদা কবিতায়ও তো জীবনের কথা, সমাজের কথা, রাজনৈতিক বাস্তবতা, মানুষের লোভ-লালসা-নিষ্ঠুরতা সবই তুলে এনেছিলেন, কিন্তু তবু তাকে স্বপ্নবিলাসী, নির্জন, পলাতক, অসচেতন বলা হতো। আবার একেবারে বিপরীত খেতাবও পেয়েছে। অন্নদাশঙ্কর বললেন শুদ্ধতম কবি, অন্যদিকে কবিতায় অশ্লীলতার দায়, বিদেশি কবিতা নকলের অভিযোগ উঠলো তার কবিতা নিয়েই! গদ্য আবিষ্কারের পর তার সমাজ সচেতনতা, রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে খুব বেশি পর্যালোচনা হতে থাকলো। হতে পারে ততদিনে পরের প্রজন্ম চলে এসেছিল, যারা জীবনানন্দের কবিতা আগেই ভালোবেসেছিল এবং গদ্য আবিষ্কার হবার পর আরও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এবারও একটি জিনিস ঘটলো, ক্লিশে সমালোচকেরা গল্প-উপন্যাসগুলোকে বিশেষত মাল্যবান-কে আমাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনী বানিয়ে ফেললো। ঘুরেফিরে এ নিয়েই আলোচনা চলতে থাকলো। মাল্যবান আবিষ্কার হবার পরপরই আমি ছাপতে দিইনি, কারণ অসুখী সংসারের একটা রূপায়ণ তো ছিল সেখানে। ততদিনে অর্থাৎ তোমার দাদার মৃত্যুর পর থেকে সেই সময় পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ বিব্রতকর। আমি বুঝতে পেরেছিলাম মাল্যবান ছাপা হলে, এটাই একটা সাদাকালো বয়ান হয়ে উঠবে আমাদের সংসারের। তখন বাচ্চারা বড় হয়েছে, একটা স্কুলের দিদিমনি হয়েছি, আবারও একটা ঘূর্ণির চাপ আমি আর নিতে পারছিলাম না। কিন্তু ঠাকুরঝি, তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে যে, এতটাই বীভৎস আমি ছিলাম না আর তোমার দাদাও এমনতরো ব্যক্তিত্বহীন ছিল না?

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এবারের পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক নয়, কার্যকর করতে চাই: আইজিপি
এবারের পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক নয়, কার্যকর করতে চাই: আইজিপি
ধর্ষণের অভিযোগে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু
ধর্ষণের অভিযোগে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
‘জবাবদিহি নিশ্চিতে ডিএনসিসির সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে’
‘জবাবদিহি নিশ্চিতে ডিএনসিসির সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে’
সর্বাধিক পঠিত
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
রিজার্ভ আরও বাড়লো
রিজার্ভ আরও বাড়লো
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’