হ্যাঁ ঠাকুরঝি, কেউই তোমার দাদাকে পুরোপুরি চিনতে পারেনি। আরও কত বছর ধরে যে তাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা চলতে থাকবে, কে জানে! রহস্যময়তা শুধু সাহিত্যজগতে নয়, সংসার জীবনেও সে ‘খাপছাড়া’, ‘কেমন যেন’—এইসব অভিধায় ভূষিত ছিল, এতো তুমিও জানোই। তোমার দাদাকে নিয়ে আমার শ্বশুর, শাশুড়ি ও পিসশাশুড়ি প্রত্যেকেরই তো প্রবল আক্ষেপ দেখেছি বরিশালের বাড়িতে। এতো ভালোবাসার যে সন্তান, সেও কী পরিমাণ বিরক্তির উপাদান হয়ে উঠেছিল যে আমার শ্বশুর যাকে সবাই ঋষি বলতো, তিনিও একেক সময় বিরক্তিতে তার ঋষিভাব হারিয়ে চেঁচিয়ে উঠতেন। সংসারের দুর্দিনের কথা বার বার বলার পরেও, তোমার দাদা নিজে একটি চাকরি তো জোগাড় করতে পারেইনি, তার বাবার জোগাড় করে দেয়া দুটো চাকরিই খুইয়েছিল। আমার শ্বশুর সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন, আমি গর্ভবতী অথচ তোমার দাদার কোনো হেলদোল নেই দেখে, আমার শ্বশুর জিজ্ঞেস করেছিলেন, জীবন সম্পর্কে সে কী ভাবছে, তো তোমার মিলুদা বলেছিল—ওসব নিয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে না। এখন আমি জানি, মনে মনে সে তখন আবার ব্যাচেলর হয়ে যাওয়ার কথা ভাবতো। এক সময় আমার শ্বশুর এমনও সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন যে, আস্তে আস্তে তোমার দাদা পাগল হয়ে যাবে কিনা। দুটি চাকরির তদবির করার পর, তিনি আর সাহস করেননি ছেলের জন্য নতুন করে তদবির করতে।
বাড়ির মানুষ, প্রতিবেশী সকলেরই ওই এক মত ছিল ‘সে কেমন যেন’। অনেককেই হাসাহাসি করতে শুনেছি যে, সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, কথা বলতে বলতে ভুলে যায়, হাঁটতে হাঁটতে একা একা কথা বলে—হয়ত কবিতা ভাবনায় ডুবে থাকতো বা কবিতা আওড়াতো বলে মনে হতো, একা একা কথা বলছে। তাছাড়া প্রবল ঘোরের মধ্যে থাকতো তো কখনো হাসছে, কখনো চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করছে—এমন তো হামেশাই হতো, অন্যেরা তো এমন দেখেনি কখনো। আসলে সাধারণের সমাজ থেকে যে আলাদা, তাকে সবাই সন্দেহ করে। তাদের মহৎ বাড়ির কেউ যাকে বুঝলো না, বাবা মা যাকে সন্দেহ করছে, যার প্রতি বিরক্ত, সেই সৃষ্টিছানাকে আমি কী করে বুঝতে পারব। তুমিও তো পালিয়েছিলে তাই না? তুমি পালিয়েছ, কিন্তু আমি হাল ধরতেই চেষ্টা করেছি। কী কয়টা মন্ত্র পড়লাম আর একঘন্টার মধ্যে আমার জগৎটাই উল্টে গেল। বছরের পর বছর নরকের যন্ত্রণা ভোগ করলাম।
তার সাহিত্য জগতের কোথাও আমার ন্যূনতম অস্তিত্ব ছিল না বললে হয়ত ভুল হবে। অস্ত্বিত যত যা ছিল, সবটাই নেতি। তবু আমি কিন্তু তাকে ছেড়ে যাইনি শোভনা। সন্তান আমাদের দু‘জনেরই প্রাণ ছিল। অভাবের সংসারে ঘরের সব কাজ করে, চাকরি করে সন্তানদের নিয়ে খুব কষ্ট করেই গুছিয়ে সংসার করেছি। তোমার দাদা যে হাজার হাজার কবিতা আর শত শত গল্প উপন্যাস ডায়েরি লিখেছে, এর জন্য পড়ার টেবিলে কী পরিমাণ সময় ব্যয় করতে হয়েছে হিসাব করতে পার? সেটাও আবার সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে নয়, সংসারের প্রয়োজনের জন্যেও নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সংসার চালানোর জন্য দিনরাত লিখেছেন, লিখতে লিখতে নিজের স্বাস্থ্যের দিকে তাকালেন না, শেষপর্যন্ত জীবনটাই দিলেন, বুদ্ধদেব বসুও একরকম গুছিয়ে নিয়েছেন লেখা দিয়ে, ডা. নিহাররঞ্জন গুপ্তের মতো রদ্দি লেখকেরও লেখালেখি করেই রমরমা অবস্থা হয়েছিল, শুধু তোমার দাদা কোনোটাই করেনি। এতো যে লেখে দিনরাত অথচ তা থেকে কোনো আয় নেই! আমি তো অন্য অনেকের মতো ছুঁড়ে বা ছিঁড়ে ফেলিনি ছাইপাঁশ বলে? আমি যদি তেমন খেকোই হতাম, বাড়িতে টিকতে পারতো না লিখতে পারতো?
বেবি, ওই সময়ে অর্থাৎ যখন কিনা তোমাদের প্রেম থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে আর তোমার দাদা চাকরি নিয়ে দিল্লী রামযশ কলেজে চলে গেল। সেই পুরো সময়টা সে নাকি একটি কবিতাও লিখতে পারেনি। সেজন্যই সংসারের নিদারুণ অভাব জেনেও আর তার মা-বাবার বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও, সে চাকরিটা বজায় রাখতে কোনো চেষ্টাই করেনি, এতটাই গোঁয়ার সে। তারপর বরিশাল এসে মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে চুপচাপ বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলো, বিয়ে করলো! সে তো নিঃসন্দেহে জানতো, সে দিল্লী ফিরবে না! সে যে নিজে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারবে না, তাও সে জানতো। বেকারত্বের অভিজ্ঞতাও তার ছিল। সিটি কলেজের চাকরি চলে যাবার পর অনেকদিন সে বেকার ছিল, তখনো তার নিষ্ক্রিয়তার জন্য অনেক গঞ্জনা তাকে সইতে হয়েছে। বেকার বলে সে সময় তার বিয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়নি, যথেষ্ট বয়স হওয়া সত্ত্বেও। তারপর আমার শ্বশুরকেই রামযশ কলেজের চাকরি জোগাড় করে দিতে হয়েছে। সেই চাকরিটিও সে খুইয়ে এসে সংসারের কাঁধে চেপেছে এবং বাবা মাকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে আরো একজনকে চাপিয়েছে, এরপর আরও একজনকে চাপানোর ব্যবস্থা করেছে। কী নাম দিই এই অদ্ভুত চরিত্রের?
আমি তো বিয়ের পরদিন থেকেই দেখলাম তাদের সংসার অভাব অনটনে বিধ্বস্ত। কিন্তু সে যে চাকরি করে না, সেই দোষও যেন আমার! বিয়ের পর পর তো গাঁয়ের লোক চুঁ চুঁ করেছে—এত বড় বাড়ির এম,এ পাশ ছেলে বিয়ে করে কিছুই পেলো না। এখন তারা যেন তামাশা দেখতে লাগল। সবার ভাবটা এমন আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না বলেই যেন সে চাকরি না করে ঘরে বসে আছে। হ্যাঁ সত্যিই তাই, বিয়ের পর পর সারাক্ষণই আমার সাথে সাথে। দিনের পর দিন বরিশালে বসে আছে, বড়ির সবার অস্থিরতা বাড়ছে আমার ওপর, অসন্তুষ্টি বাড়ছে দেখছি, ফলে একদিন জিজ্ঞেসই করে ফেললাম কবে যাবে দিল্লী আর তখনই জানলাম চাকরিটা নেই! ভাবতে পার আমার মনের অবস্থা? নিজেকে বসাও সেখানে বেবি। একটি মেয়ে বরিশালের গ্রাম্য পরিবেশ, মাটির ঘরবাড়ি, অভাব অনটন কোনোভাবে সয়ে নিচ্ছে, এইদিন দীর্ঘ হবে না—সামনে সুদিন স্বপ্নে দিল্লী আর এক ঝটকায় স্বপ্ন শুধু ভেঙে চুরমারই হলো না, আতঙ্কে অস্থির হয়ে ভাবতে হলো, এরপর কী!
আমি তখন সম্পূর্ণভাবে ট্রমাটাইজ, খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না—চোখের জল সারাক্ষণই ঝরছে। এদিকে আবার তার শরীরের চাহিদা মারাত্মক! সারাক্ষণ ঘুরঘুর করছে! এর মাঝেও সে কী করে কাছে আসতে চাইতো কে জানে! তার খাওয়াদাওয়া, লেখালেখি, ঘুরে বেড়ানো সবই ঠিকঠাক চলছিল! মঞ্জু হওয়ার পর তো আমার স্বাস্থ্য গেল ভেঙে, শুকাতে শুকাতে কঙ্কাল হয়ে গেলাম। মঞ্জু আর আমি অপুষ্টিতে ভুগতে লাগলাম। সেইসাথে নতুন করে গর্ভধারণের ভয়ে দিশেহারা, তোমার দাদাকে কাছে ঘেঁষতে দিই না, বার বার বলি কোলকাতায় গিয়ে একটা চাকরির চেষ্টা করতে। এবার কলকাতায় ঘন ঘন যায়, সেই টাকাও আমার শ্বশুরকেই জোগাতে হয়। এও আমারই দোষ, আমি তাকে বেঁধে রাখতে পারিনি! শাশুড়ি, পিসশাশুড়ি অসন্তুষ্ট শ্বশুর গম্ভীর। এতবড় খোলামেলা ঘরবাড়ি কিন্তু আমার যেন দমবন্ধ হয়ে আসতো। কবে এই বাড়ি থেকে আমি মুক্তি পাবো সেই আশায় দিন গুনতাম। তাকে বলতাম সেই কথা, কিন্তু তাকে যেন আমার সেই আকুতি ছুঁতোই না! আসলে সে এড়িয়ে যেতো। উপায় ছিল না বলে, না শোনার ভান করতো।
শোভনা, তোমার দাদার অস্থির ছোটাছুটি সবই আমি দেখছিলাম, জানছিলাম। কিন্তু যারা বলে যে তা শুধুই তোমার জন্য, আমি তাদের সাথে একমত না। এখন তো নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, পুরোপুরি তা নয়ও। তুমি বা আমি এমনকি আত্মীয়-পরিজনও না, মানুষটির আত্মা ছিল সাহিত্য। তাই কলকাতা যাওয়ার সময় ভাব করতো চাকরির চেষ্টায় যাচ্ছে, কিন্তু প্রধান উদ্দেশ্য ছিল লেখা ও লেখকদের কাছাকাছি থাকা। সে একেবারেই সাধারণ সংসারী মানুষ ছিল না। কাফকার ভক্ত ছিল। নিজেকে সে নিজেই বলেছে ‘জাত সাহিত্য প্রেমিক’—জাত লেখকও সে, জানতো লেখা ছাড়া তার উপায় নেই, লিখতে তাকে হবেই। সাহিত্যের জন্য এই মানুষটা সবই স্যাক্রিফাইস করেছে। তবে কলকাতা যাওয়ার পর, তোমার সাথে দেখা করার ইচ্ছেটা চাগিয়ে উঠতো হয়ত। কবিতার সাথে প্রেমের একটা সম্পর্ক তো আছে। অনেকেই বলে, প্রেমে পড়েই নাকি প্রথম কবিতাটি লেখা হয়। তোমার দাদার ক্ষেত্রে অবশ্য তা মিলিয়ে নেয়া মুশকিল, চরম প্রতিকূল অবস্থায়ও সে দুর্দান্ত সাহিত্য রচনা করেছে। তা ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রমই, ব্যতিক্রম তো উদাহরণ হতে পারে না কি বলো?