X
সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২
ধারাবাহিক উপন্যাস

লাবণ্য দাশের চিঠি ।। পর্ব—দুই

শাহনাজ নাসরীন
১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৩৩আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪:২৪

‘ঢাকার মেয়েরা এমনই জ্যান্তখেকো’— এমনটাই বলেছিলে না? কী মানে এর? তোমার দাদার সংসার থেকে কতটুকু খেয়েছি আর কতটুকু দিয়েছি তা তোমার খুব ভালোই জানা আছে বেবী। অন্য সকলে আমাকে খারাপ জানুক,  তবু তোমার মুখে একথা শোভা পায় কি? পরিবারের সকলে সারাজীবনই আমার বিপক্ষে ছিল তাই বলে তুমিও! সব জেনে বুঝেও এমন অশ্লীল মিথ্যাচার করতে পারলে! অথচ তোমার সাথে আমি সাধ্যের অতীত ভালো ব্যবহার করেছি কিনা বলো? তুমি যা করেছ তার তুলনায় আমি যে প্রায় দেবীতুল্য সম্মাননার যোগ্য গো!

আমরা দুজনেই যে একই মানুষটিকে প্রত্যাখ্যান করেছি। তবু তোমার আর আমার প্রত্যাখ্যানের তুলনা কিছুতেই হয় না। তুমি মরজিমাফিক ভালোবাসা দিয়েছ নিয়েছ আবার নিজের সুখের জন্য ত্যাগও করেছ। সম্পূর্ণ ত্যাগও আবার করোনি কুহকের মায়াজালে জড়িয়ে রেখেছ। মানুষটি সারাটা জীবন অসন্তোষের দাহর মধ্যে যে কাটাল তার কোনো দায় কি তোমার নেই? আর আমি বিয়ের রাতে যাকে গান শুনিয়েছি পরদিনই জেনেছি সে চাকরি নিয়ে মিথ্যাচার করেছে। কেমন লাগে তখন? কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে বুঝতে পরো নিশ্চয়ই? 
তোমার দাদা তো অন্তত জানতেন তার মন। চাকরিতে আর ফিরবেন না জেনেও রামযশ কলেজে চাকরির কথা কেন বলতে গেলেন এই প্রশ্ন কেউ তোলে না অথচ আমার মানসিক বিপর্যয়ের শুরু হলো সেখান থেকেই। আমি কিন্তু তোমার মতো নিষ্ঠুর না ঠাকুরঝি। এই যে অসুন্দর একটা মানুষের সাথে অনিচ্ছাকৃত বিয়ে তারপরেও তো গান শুনিয়েছি। দিল্লী গিয়ে বেশ সুন্দর করে একটা সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখেছি। এ কি খুব বেশি চাওয়া? অথচ সেখানেও প্রতারণা মিলল!

সেই গানের কথাই ধরো, গাইতে বললো রবীন্দ্রসংগীত— জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছ দাড়ায়ে। পরপর দু’বার গাওয়ালো। খটকা লেগেছিল, তা তখন তো জিজ্ঞেস করতে পারিনি অনেক পরে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, খটকা লুকিয়ে হাসতে হাসতে। তা প্রথমে এড়াতে চাইল তারপর উত্তর দিল। কিন্তু গেল মাথার ওপর দিয়ে একেবারে স্যুরিয়াল! এখন জানি একসময় তোমরা জীবন-মরণের প্রতিজ্ঞাই করেছিলে। কিন্তু পরেও তুমি বদলে যাচ্ছিলে। তোমার দাদা অনেকভাবে চেষ্টা করেও যখন তোমার পরিবর্তন ঠেকাতে পারেনি তখন পরীক্ষামূলকভাবে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। হয়ত ভেবেছিল তাতে তোমাকে আঘাত করা যাবে, তোমার ঈর্ষা জাগবে, তুমি হয়ত বাধাও দেবে।

তুমি তোমার দাদার স্বভাব বুঝতে পেরে, নিজের চাওয়াপাওয়াকে সামনে রেখে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছ এটা সে ভাবতেই পারেনি কখনো। কিন্তু আমি বুঝতে পারি। ভালো বা মন্দ সে বিচারে আমি যাইনি কখনো তবে তোমার তো আমাকে বুঝতে পারা উচিত ছিল। যে মানুষটা স্রেফ তার অস্থিরতা, যৌবনের অপচয়, সমাজের প্রয়োজন ইত্যাদি ভেবে তোমার উপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে হয়ে আমাকে বিয়ে করার এবং কোনোদিন ভালো না বাসার সিদ্ধান্ত নেয় তার সাথে মধুর একটা দাম্পত্য গড়ে ওঠা কী করে সম্ভব বেবী? আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি তোমার ওই বাক্যবাণে। অবাক হইনি অবশ্য। ততদিনে জেনে গেছি পুরুষরা নিজেরা শত্রুতা করেই ক্ষান্ত হয় না নারীসমাজেও তাদের প্রতিনিধি বানিয়ে রাখে যেন সেই নারীরা যে-সব নারী লক্ষ্ণনরেখা ডিঙোতে চায় তাদেরকে যথাসাধ্য ঠেকায় পারলে ঠ্যাং ভেঙে দেয়। আর ক্রীড়নক নারীরা যখন মন-প্রাণ ঢেলে সেই কাজটিতে ব্যস্ত, পুরুষ তখন নিজেদের বেশ নিরাপদ দূরত্বে রেখে বলতে পারে নারীই তো নারীর বড়ো শত্রু!

সময়ের আন্দাজে আমি ছিলাম এগিয়ে থাকা মেয়ে। আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল। বৃটিশের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলনে জড়িত ছিলাম। আমার মতো মেয়ের তো বিপ্লবী হওয়ার কথা বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে ঢাকার পর কলকাতায় যাত্রা করার কথা। কোনোভাবেই বিয়ে করে বরিশালের একটি গ্রামের একান্নবর্তী পরিবারের দায়িত্ব সামলাবার কথা নয়! সত্যি বলতে আমি জেঠার গলগ্রহ হয়ে ছিলাম বলেই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম এটি একটি কারণ বটে তবে যদি জানতাম তোমার দাদা বেকার এবং বরিশালে ওভাবে জীবন কাটাতে হবে তাহলে জেঠার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে গেলেও বিয়েতে রাজি হতাম না আমি। সত্যটা জানলে হয়ত জেঠাও আমাকে বিয়ে দিতে রাজি হত না। তবে তোমার দাদাকে পছন্দ না হলেও দিল্লীতে কলেজে পড়ায় শুনেই আমি রাজী হয়েছিলাম। নিজের একটা স্বাধীন সংসার আর একেবারে কেন্দ্র থেকে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল আমার লক্ষ্য। অথচ ঘটল কী! এখানেও বিধাতার কী ভীষণ ঠাট্টা! সবাই আমার সৌভাগ্যের জয়গানই করেছে! এমন উচ্চশিক্ষিত স্বামী, এমন শ্বশুর শাশুড়ি বনেদি পরিবার! কিছু দিতেথুতে হয়নি তারাও কোনো দাবি জানাননি। এমনকি প্রতিবেশীরা যৌতুকের কথা বলায় তোমার দাদা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেছিল। আমার শ্বশুর তো অহংকার করে বলতেন তাদের আর্টিস্ট পরিবার। কথাটা মিথ্যে নয়। মননে তারা শিল্পী বটে। স্বভাবে ধীরস্থির, নির্লোভ, ধর্মপরায়ণ, পরোপকারী। আমার শাশুড়ি মা নিজে কবি তার বাবাও কবি এবং গীাতকার, বড় ছেলে কবি। তাদের বড়িতে শুধু বই আর বই। নারী পুরুষ প্রতিটি মানুষ লেখাপড়া করে। এমনকি কবির জেঠিমাকে দেখেছি অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন, পড়াশুনা করেননি তেমন অথচ এই বাড়িতে এসে বাংলা ইংরেজি দুটোই শিখেছিলেন এবং সারাদিনের কাজের পরেও বই পড়তেন একটু সময় বের করে। এহেন দেবোপম বাড়িতে আমার প্রতি মনোভাব বলতে গেলে মা-বাপ মরা আদর আহ্লাদে বখে যাওয়া হতচ্ছারীর। আমি রাগী, আমি জেদী। সংসারের কোনো দায়িত্ব পালন করি না। জেঠিমা আর শাশুড়ি মা সারাদিন সংসারের কাজ করেন তোমার দাদা আশা করতেন আমি তাদের ভার লাঘব করব কিন্তু আমি আসলেই তা পারিনি। আমি একটু শৌখিন। সাজতে ও সাজাতে ভালোবাসতাম। তাদের বাড়ির আর্টিস্টদের মতো না খেয়ে না পরে খুশি থাকতে, মনে মনে বনেদিয়ানার জাবর কাটতে পারিনি।

তোমার দাদাও কি পেরেছিলেন? মনে মনে তিনিও বিদ্রোহী ছিলেন। ব্রাহ্মধর্মের কিছুই তিনি পালন করেননি। এত কঠোর নিয়ম কানুন তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। কিন্তু স্পষ্ট বিদ্রোহ করা তার স্বভাব ছিল না তারপরেও সকলেই বুঝতে পারত ওর মনোভাব। সে যাই হোক, আমি তাদের নিন্দা করছি না, তারা একরকম আমি অন্যরকম। আমার বেড়ে ওঠার সাথে তাদের জীবনযাপনের যুগান্তরের ব্যবধান। কী করে আমি খাপে খাপ মিশে যেতে পারতাম? কিন্তু আমাকে যত হেলাফেলার যত নিন্দার শিকার হতে হয়েছে এই সমাজে, ততখানি আমার প্রাপ্য ছিল না এ আমি বলবই।

শুরুতে গ্রামে গিয়ে ওই মাটির মেঝে খড়ের চালার বাড়ি, বেকারত্ব নিয়ে তোমার দাদার মিথ্যাচার সবকিছু একসাথে যখন ঘাড়ে পড়ল বার বার আত্মহত্যার কথা ভেবেছি কিন্তু সেই সময়টাও পেলাম না মঞ্জু চলে এলো পেটে। একেবারে প্রথমবারের পরিকল্পনাহীন প্রস্তুতিবিহীন স্বামীসঙ্গের রাতেই। আমাদের জীবনযাপন অনেকটাই তো দেখেছ তুমি? তবু তোমাদের পরিবারের অন্যদের মতো বউয়ের দোষটাই ধরলে! তুমি না আধুনিক নারী? তাহলে কী করে পুরুষের মতোই বললে ঢাকার মেয়েরা খেকো? যেমন আমার শাশুড়ি কবি হয়েও আমার প্রতি হয়ে উঠেছিলেন সনাতন শাশুড়ি? আমার ননদ সুচরিতাও উচ্চশিক্ষিত হয়েও আমাকে কেবলই কোণঠাসা করে গেল পরিবারে। নারী হয়ে সমবয়সি আরেক নারীর চাওয়া-পাওয়ার অধিকারটুকু অনুভব করার মনন তোমারও হলো না! তোমার অন্তত আমাকে বুঝতে পারার কথা ছিল! সেদিক থেকে তোমার দাদা বরং অনেক সৎ। মাকেও রেয়াত করেনি। মা ভক্ত ছেলে হয়েও আমার সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধানোর দুর্নাম দিয়েছে, বিরক্তি প্রকাশ করেছে। বাবাকেও কৃপণ বলতে ছাড়েনি।

আমার আশা আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হলো। তখন তোমার দাদা কিন্তু আমার প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ায় না, স্বপ্ন দেখায় না আগামীর, সামান্য সান্ত্বনা পর্যন্ত দেয় না। প্রতিদিন আমার স্বপ্ন ভাঙছে আমি একটু একটু করে মরছি। তোমার দাদা নিরুত্তাপ লেখে। সারাদিন লিখতেই থাকে। একটা চাকরির চেষ্টা পর্যন্ত করে না। যাও বা কিছু পায় আগ্রহ নিয়ে করে না ফলে চাকরি চলে যায়। আর একেকবার কলকাতা গিয়ে তো দীর্ঘ সময় সেখানেই কাটিয়ে দেয়। বেকার ছেলের বউয়ের কী নিগ্রহ তা তোমার দাদাকে কিছুতেই বুঝাতে পারি না। নতুন বউ আমি, কিছু চাহিদা যে থাকতে পারে তাতো বাদই দিলাম, প্রসূতির তো সেবা লাগে, এটা-সেটা খেতেও মন চায় ঐ বাড়িতে কার এসব দেখার কথা ছিল? অনিচ্ছাকৃত মাতৃত্বের সবটুকু দায় আমাকেই বইতে হয়েছে। হীনমন্যতায় কুঁকড়ে যেতে যেতে এক একদিন বিদ্রোহ করেছি, চিৎকার করেছি। সবাই আমার দোষ দেখেছে। তোমার দাদা পর্যন্ত বিরক্ত। আমার মাথায় ভূত কেন চাপে সে বোঝে না! কতবার যে আত্মহত্যার কথা ভেবেছি। স্রেফ বাচ্চাটা পেটে ছিল বলে করা হয়নি।
চলবে

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এবারের পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক নয়, কার্যকর করতে চাই: আইজিপি
এবারের পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক নয়, কার্যকর করতে চাই: আইজিপি
ধর্ষণের অভিযোগে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু
ধর্ষণের অভিযোগে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
‘জবাবদিহি নিশ্চিতে ডিএনসিসির সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে’
‘জবাবদিহি নিশ্চিতে ডিএনসিসির সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে’
সর্বাধিক পঠিত
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
রিজার্ভ আরও বাড়লো
রিজার্ভ আরও বাড়লো
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’