X
শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪
২১ আষাঢ় ১৪৩১

ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা

গৌতম গুহ রায়
০২ জুলাই ২০২৪, ১৩:৪৬আপডেট : ০২ জুলাই ২০২৪, ১৩:৪৭

২১তম পর্ব


চুরি বা চোরেরা তো আমাদের সমাজের এক বহুচর্চিত অংশ হয়ে আছে হাজার হাজার বছর ধরে। সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতির ময়দানেও সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক স্লোগান তো ‘চোরের মায়ের বড় গলা’। এই ‘চোরদের’ নিয়ে আটের দশকে  অরুনেশ ঘোষের নির্দেশে ‘জিরাফ’-এর জন্য একটা গদ্য লিখতে বলেছিলেন। সেটা লিখতে গিয়ে বারংবার সেই ছেঁড়া গামছা ও মাংসের টুকরোতে এসে আটকে যাচ্ছিলাম আমি। আমি সেই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত হতে পারিনি, আদৌ কী কোনো কান্নার স্মৃতি, যন্ত্রণার স্মৃতি থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারা যায়? গদ্যটা লিখতে লিখতে দেখলাম আমার চারদিকে চোরেরা নিশ্বাস ফেলছে, আমাদের চেনাজানা মানুষেরা, হাভাতে, ছ্যাঁচড়া চোর থেকে বৈভবের মিনারে থাকা, কোট প্যান্ট হ্যাট জড়ানো মানুষজন।

‘চুরি’ নিয়ে যখন লিখছি সেই সময় একদিন আমাদের আধিয়ার বিষ্টু মায়ের কাছে তাঁদের গ্রামের ‘চোর চুল্লি’ পালার গল্প করছিল। মা বিষ্টুকে আমাদের আদি সাহিত্যেও, সংস্কৃত নাটকে চোরের গল্প আছে বলে শুদ্রকের কথা বলেছিলেন। সেই শুনে অষ্টম শ্রেণীতে পড়া আমার ছোট্ট মেয়েটা বায়না ধরলো তাদের চোরের গল্প বলতে হবে। সন্ধ্যাবেলায় ওরা, আমাদের যৌথ পরিবারের বাচ্চাকাচ্চাদের সঙ্গে সেদিন চোরের গল্প শুনাতে বসলাম। চামড়ার মাংসের কাহিনি এড়িয়ে ওদের চুরি ও মানুষের আদিকালের সম্পর্কের কথা শোনালাম। ওই সন্ধ্যারাতে আমাদের বারান্দায় একে একে হাজির হওয়া আগ্রহীদের সজ্জালকের গল্প করলাম, শার্বিলকের কথা বললাম, ‘দশকুমারচরিত’-এর অপহারবর্মার গল্প করলাম, সনাতনী ভারতের সংস্কৃত সাহিত্যের চোরদের গল্প শোনালাম। ‘চৌর্যশাস্ত্র’ বলে এক শাস্ত্র হাজার বছর ধরে সংস্কৃত সাহিত্যের সম্পদ হয়ে আছে যেটা জেনে ওর কী খুশী। ওরা অবাক হল যখন বললাম যে বেদে চোরের উল্লেখ রয়েছে, বেদ রচনা মানে সেই তিন চার হাজার বছর আগের ব্যাপার। বাল গঙ্গাধর তিলকের মতে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০০ থেকে ২৫০০ অব্দের মধ্যে কোনো সময় বৈদিক সংহিতা ও ব্রাহ্মণ ভাগ রচিত, জার্মান অধ্যাপক এইচ জ্যাকোবিও তেমনই বলেছেন। আবার ম্যাকডোনাল খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০ বা ১৫০০ অব্দকে ঋকবেদের রচনাকাল বলেছেন। এমন নানা ‘মুনি’-এর নানা মতের মধ্যেও তিন চার হাজার বছরের পুরোনো যে বৈদিক সাহিত্য তা নিয়ে বিরোধ নাই। সেই ঋকবেদের প্রথম মণ্ডলের ১১ সুক্তের পঞ্চম মন্ত্রে বলা হয়েছে বালাসুর নামক এক চোর দেবতাদের গাভি অপহরণ করে কোনো এক গহ্বরে লুকিয়ে রেখেছিল—‘ত্বং বলস্য গোমতোহপাবরদ্রিবো বিলোম।’ এরই ৩৯ সুক্তের অষ্টম মন্ত্রে কণ্ব ঋষি মরুতগণকে জানিয়েছেন যে, যাদের দ্বারা শত্রুরা উত্তেজিত হয়, মরুতগণ যেন তাদের খাদ্য, বল ও সহায়তা চুরি করেন—

‘যুষ্মোষিতো মরুত মর্ত্যেষিত আ যো নো অভব ঈষতে।
বিতং যুযোত শবসা ব্যৈজসা বি যুষ্মাকাভিড়ুতিভিঃ।’

এমন নানা মন্ত্রে চুরি সম্পর্কিত উদাহরণ বেদে দেখা যায়। চোর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তারা শেষ রাতে চুরি করে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আত্মোগোপন করে। ৬৫ নম্বর সুক্তিতে বলা হয়েছে চোরেরা চুরির পর যে পদচিহ্ন রেখে যায় তা অনুসরণ করে চোরদের ধরা যায়।

খবরে দেখলাম কয়েকদিন আগে এক পকেটমার ধরা পড়লে তাকে ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। এটা খবরের কাগজে পড়ে আমার খুতোতো দাদার ছেলের খুব মন খারাপ। সরল মনে ও সেদিন বলল, ‘কাকা, ছোট ছোট চোরদের প্রতি মানুষ এতো অমানবিক কেন? অথচ দেখ, বড় বড় চোরদের মাথায় করে রাখে তোমাদের সমাজ!’ এর উত্তর সেদিন দিতে পারিনি। যাদের কিছুই নাই তারা বাঁচার জন্য চুরি করে, যাদের অনেক আছে তারা আরো পাওয়ার জন্য চুরি করে। এ এক অদ্ভুত পরম্পরা। আমাকে সমর্থন করে ও বলল, ‘জানো কাকা, আমাদের ইন্ডিয়া ক্রিকেট টিমের সদস্য সুধীর নায়েক ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়ে এক দোকানে মোজা চুরির করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে!’ চুরি আসলে সমাজের সর্বস্তরে শ্রেণি নির্বিশেষে বহাল তবিয়তে আছে, ছিল। সেদিনের শ্রোতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আমার সোনা জ্যাঠামশাইয়ের ছেলে পার্থ, ও একবার ‘বোস কাকু...’ শব্দটা উচ্চারণ করেই থেকে গেল। এ ওর মুখের দিকে তাকাল, আমি ওদের চুপ করিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইলাম। ওদের বলছিলাম প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের একটি অনন্য গ্রন্থ “ষণ্মুখকল্পম”-এর কথা, যার বিষয় চুরি বিদ্যা এবং দেব সেনাপতি কার্তিকেয় চৌর্যশাস্ত্র প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে ছিলেন, ওরা চমকে উঠল।

মেয়েদের বললাম যে আমাদের অনেক প্রাচীন শাস্ত্র যেমন ইউরোপীয় গবেষকরা আলোচনার আলোতে নিয়ে এসেছেন তেমনি এই “ষণ্মুখকল্পম” নিয়েও প্রথম গবেষণা করেছিলেন জার্মান পণ্ডিত ডেইটর জর্গ, সেই ১৯৬৬ সালে। আমাদের একটা মজার বই আছে, চঞ্চল ভট্টাচার্যের লেখা, ‘The concept of Theft in Classical Hindu Law’। এখানে ড. ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘Theft, a title of law occurs when a person takes someone else’s belonging that is unguarded, without his cognizance and permission. The above title of Law also arises when a person takes someone else’s property that is guarded and conceals such an act’. শাস্ত্র মতে এই চুরি যেহেতু একটা কলাবিদ্যা তাই যখন কোনো চোর জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশ করবে তখন সে অত্যন্ত সুন্দর ও আকর্ষণীয় ভাবে নিজেকে উপস্থিত করবে।

একসময় ‘সন্দেশ’ ছিল আমাদের ছোটবেলার একটা মায়ায় জড়ানো পত্রিকা। সেখানে ‘চোর চক্রবর্তী’ বলে একটা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। পুরোনো বাংলায় একাধিক পাঁচালির সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে চোরের কথা আছে। এরই একটি এই ‘চোর চক্রবর্তী’। এটি ১৮৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দে গোলাম মোলা নামাঙ্কিত মোহরযুক্ত। এই পাঁচালির চতুর্থ সংস্করণের একটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রক্ষিত আছে, এর নকলের তারিখ ১১৭২ সাল। এক প্রসিদ্ধ সুচতুর চোরের কাহিনি এখানে বর্ণিত হয়েছে।  চোরের বয়ানে তার নাম খরবর, বাড়ি বিক্রমপুর। চম্পাবতী নগরের মানুষেরা কোটালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে চোর চক্রবর্তীর স্মরণ নেয়। এরপর চোর চক্রবর্তী ‘প্রত্যুষকালে’ তপস্বীর ছদ্মবেশে চম্পকনগরে প্রবেশ করে। এরপর সে নানাভাবে চৌকিদার, গোয়ালিনি, রাজার মালী, নাপিতকে ঠকায় বা তাদের ঘরে চুরি করে, এরপর কোটালের ঘরে চুরি করে নিজের নামের সার্থকতা প্রতিপাদন করে। এরপর সে রাজার ঘরে চুরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই নিয়ে বেশ রসালো কিছু ঘটনা ঘটে। চোর খরবর নিপুণ মুন্সিয়ানায় রাজার পাশে শুয়ে থাকা রাণীকে তুলে নিয়ে নগরীর প্রান্তে ঘুমন্ত গরিবের ঘরে শুইয়ে দিয়ে তার স্ত্রীকে নিয়ে এসে ঘুমন্ত রাজার পাশে শুইয়ে দেয়। রাজা চোর ধরার জন্য কলাধর নামে এক সর্বজ্ঞকে ডেকে আনলেন। চোর সর্বজ্ঞকে জব্দ করার জন্য রাতে তার বাসায় হাজির হল। সে কলাধরকে বলল, রাজা তার জন্য গুয়াপান পাঠিয়েছেন। যেই কলাধর হাত বাড়িয়েছে অমনি চোর সেই হাত কেটে ফেলে এবং তা সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। এরপর সে রাজার ঘরে সিঁধ কাটতে যায়। সিঁধ কাটার পর সেই গর্ত দিয়ে কেউ জেগে আছে কিনা জানার জন্য ওই কাটা হাতটা ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। রাজা তাতে খড়্‌গ দিয়ে আঘাত করে। চোর সেই কাটা হাত ফেলে পালিয়ে যায়। এরপর চোর রাজার কাছে গণকের ছদ্মবেশে হাজির হয়। চোর ধরা পড়বে বলে রাজাকে কলাধরের বাসায় সে নিয়ে যায়। বলে ‘এই ঘরে চোর আছে’। রাজা দেখেন কলাধরের হাত কাটা এবং কলাধরকে কেটে ফেলার আদেশ দেন। এতে চোরের দয়া হয় এবং রাজাকে সে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, কোটালকে শিক্ষা দেওয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল, চুরি করা নয়। সমস্ত শুনে রাজা চোরের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং তার কন্যা মালাবতীর সঙ্গে ‘চোর চক্রবর্তী’-এর বিয়ে দেন। চোর তার অপহৃত সমস্ত জিনিস ফিরিয়ে দিল। নিজ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে সে চোরদের জন্য একটা উপদেশ দিয়ে স্বদেশে ফিরে যায়— ‘ব্রাহ্মণ সজ্জন দাতা বৈষ্ণব তিনজন।/ ইহার ঘরে চুরি না করহ কখন।।” এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে মনোজ বসুর ‘নিশিকুটুম্ব’-এর কথা। “...শুধু মাত্র শাসনে এ বৃত্তি উৎখাত হবার নয়—তা হলে ইতিহাসের আদিযুগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। তখনকার দিনে অতিশয় কড়া শাসন— চোরকে শূলে চড়াত, হাত কেটে দিত জলজ্যান্ত মানুষটার,...এইরকম আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে মনু সতর্ক করে দিচ্ছেন— ন্যায়বান রাজা বমাল সমেত না পেলে কোনো চোরের মৃত্যুদণ্ড দেবেন না, চোরাই মাল ও সরঞ্জাম সহ হাতেনাতে ধরলে তবেই চরম সাজা দেওয়া যেতে পারে...”

পার্থ যে ‘বোস কাকু’-এর নাম উচ্চারণের পর সবাই চুপ করে গিয়েছিলাম সেই ‘বোস কাকু’ আসলে আমাদের পাড়ার ধ্রুবজ্যোতি বোস, ফুড করপোরেশনের বড়োবাবু। সুদর্শন ধ্রুব দা সবসময় ‘কেতাদুরস্ত’ চালে থাকতেন। হঠাৎ তার বাড়িতে পুলিশ এলো, পাড়ার কৌতূহলী জনতার সামনে দিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে তাকে নিয়ে গেল। ধ্রুবকাকুর ছেলে সুপ্রতীম আমার বন্ধু, ইঞ্জিনিয়ারিং মেধা ছিল দুরন্ত, স্কুল জীবন থেকেই এটা সেটা মডেল বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিতো, স্বপ্ন ছিল প্রযুক্তি বিজ্ঞানী হবে। আমাদের বাসায় সবসময় আসত। এরপর সুপ্রতীম ওর মামাবাড়ি চলে যায়, অনেক বছর আর ফিরে আসেনি সে। শোন যায় তার বড়মামা জার্মানিতে থাকে, সেখানেই তাকে নিয়ে গেছেন তিনি। ধ্রুব কাকুর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির যাবতীয় সম্পর্ক ওই ঘটনার পর ভেঙে যায়। তিন মাস পড়ে জামিনে ছাড়া পেলেও আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি, না পাড়ায় না আত্মীয়স্বজনদের কাছে।


চলবে

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আসছেন প্রধানমন্ত্রী, পদ্মা পাড়ে উৎসবের আমেজ
আসছেন প্রধানমন্ত্রী, পদ্মা পাড়ে উৎসবের আমেজ
তিন কেজি চালের দামে মিলছে ১ কেজি কাঁচা মরিচ
তিন কেজি চালের দামে মিলছে ১ কেজি কাঁচা মরিচ
নির্মাণের ১০ দিনের মধ্যেই উঠে যাচ্ছে সড়কের পিচ
নির্মাণের ১০ দিনের মধ্যেই উঠে যাচ্ছে সড়কের পিচ
টিভিতে আজকের খেলা (৫ জুলাই, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৫ জুলাই, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
প্রেমের টানে বাংলাদেশে এসে বিপাকে পড়া তরুণীকে নিজ দেশে পাঠাতে পতাকা বৈঠক
প্রেমের টানে বাংলাদেশে এসে বিপাকে পড়া তরুণীকে নিজ দেশে পাঠাতে পতাকা বৈঠক
কী আলোচনা হলো সচিবদের বৈঠকে?
কী আলোচনা হলো সচিবদের বৈঠকে?
এমপি আনার হত্যা: ৩ আসামির দোষ স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন
এমপি আনার হত্যা: ৩ আসামির দোষ স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন
‘তুফান’ ঝড়ের পরে...
‘তুফান’ ঝড়ের পরে...
খালে এসব কে ফেলে, কেন ফেলে?
খালে এসব কে ফেলে, কেন ফেলে?