X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২
হান কাং-এর “গ্রিক লেসনস”

ভাষার নিঃশব্দ সঞ্চারণ

রিটন খান
১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:৪২আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:৪২

‘গ্রিক লেসনস’ আমাকে গভীর চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই উপন্যাসটি হান কাং-এর অন্য রচনা থেকে একেবারেই ভিন্ন পথে চলে। এটি নীরব, তবে কোনো অংশেই কম শক্তিশালী নয়। এই উপন্যাস মূলত কখনো ভাষার শক্তি নিয়ে, কখনো আবার সেই শক্তির অভাব নিয়ে।

‘গ্রিক লেসনস’ পড়ার সময় আমার মনে হচ্ছিল, যেন আমি কোনো স্বপ্নের মধ্যে হাঁটছি, স্বপ্নের ভালো থাকাগুলিকে নিয়ে ভিড়ের রাস্তা থেকে হঠাৎ হঠাৎ আলাদা হয়ে যাই—যেখানে স্পষ্ট দরদ-ভরা দুঃখের আলাপন এবং নীরবতা জড়ায় আঙুল। হান কাং-এর লেখার সৌন্দর্য একেবারেই অন্যরকম। প্রায় কবিতার মতো, যা ভাষা এবং কথোপকথনের গভীরতায় ডুব দেয়। ভাষা যখন আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যায়, তখন কীভাবে আমরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করি—এই ভাবনাটি আমাকে বারবার ভাবিয়েছে। "মনে পড়ে সে শুধু জ্যোৎস্নার ভাষা বুঝত, আমি তার হাত ধরে অন্ধকার চিনতে শিখিয়েছিলাম"।

বইটির কেন্দ্রে রয়েছে দুটি চরিত্র—একজন নারী, যিনি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন, এবং একজন গ্রিক ভাষার শিক্ষক, যিনি ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছেন। এই সেটআপটি খুবই রোমান্টিক এবং আকর্ষণীয়, যা উপন্যাসের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। নারী নীরব, এবং সে সবসময় থার্ড পারসনে কথা বলে, যেখানে শিক্ষকটি ফার্স্ট পারসনে কথা বলেন। এই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ গল্পটিতে আরও গভীরতা এনে দেয়, যা পাঠককে প্রায়ই অদ্ভুত দূরত্বে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে কোনো সরাসরি যোগাযোগ নেই, এবং সেটাই চরিত্রগুলোর বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিকে আরও তীব্র করে তোলে।

নারীর কথা বলার ক্ষমতা হারানো নতুন নয়। ছোটবেলায়ও সে একবার কথা বলা হারিয়ে ফেলেছিল, তবে ফরাসি ভাষা শেখার পর তা আবার ফিরে আসে। এখন, অনেক বছর পরে, সে গ্রিক শিখতে চায়, আশা করে যে এই নতুন, সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা আবার তার কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে আনবে। অন্যদিকে, শিক্ষকের নিজের একটি যন্ত্রণার গল্প রয়েছে। যখন তার দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করে, সে অনুভব করতে শুরু করে অরণ্য-চোয়ানো ঝাপসা আলোয় কীভাবে পৃথিবীটা ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সে আর তার শিক্ষার্থীর মুখভঙ্গি দেখতে পায় না, তার মনের ভাবনা বুঝতে পারে না, শেষ-সংযোগ ছিন্ন হয়েছে অথচ তাদের মধ্যে এক ধরনের নীরব সংযোগ তৈরি হয়, যা ভাষার চেয়েও গভীর।

কয়েক বছর আগে আমি ও আমার ছেলে ফরাসি ভাষা শিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কয়েক মাসের প্রচেষ্টার পর আমি উপলব্ধি করলাম, ভাষা শুধু শব্দ বা ব্যাকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি সংস্কৃতির একটি অংশ, চিন্তা ও অনুভূতির একটি মাধুর্য, যা শব্দের বাইরে থেকে যায়। (যেমন আমার মাতৃভাষা বাংলা হলেও আমার বেড়ে ওঠা ইংরেজি ভাষায়, তাই আমার চিন্তাও আসে আগে ইংরেজিতেই)। তখন আমি বুঝতে পারলাম, ভাষা শেখা মানে শুধু নতুন শব্দ জানা নয়, বরং একটি পুরো নতুন পৃথিবীকে বোঝা। গ্রিক লেসনস-এর চরিত্রগুলোর অভিজ্ঞতা আমাকে এই সত্যটা আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করিয়ে দেয় সর্ব দেহে মনে।

বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভাষার দ্বৈত ভূমিকা। ভাষা আমাদের জীবনে সমৃদ্ধি এনে দেয়, নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। শিক্ষক গ্রিক ভাষার প্রতি তার ভালোবাসায় এমন শব্দগুলোর কথা বলেন, যেগুলোর একাধিক অর্থ রয়েছে। এতে বোঝা যায় ভাষা কতটা গভীর এবং জটিল হতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে, ভাষা প্রায়শই একটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। নারীর নীরবতা এবং শিক্ষকের তার অনুভূতি বোঝার অক্ষমতা সেই সীমাবদ্ধতার পরিচয় দেয়। তাদের মধ্যে সত্যিকারের সংযোগ তৈরি করতে চাইলেও তা অনেক সময় অধরাই থেকে যায়।

আমরা প্রায়ই ভাবি, আমাদের ভাবনা এবং অনুভূতি প্রকাশের জন্য ভাষা সবসময় আমাদের সাথে থাকবে। কিন্তু যখন ভাষা হারিয়ে যায়? তখন আমরা কীভাবে একে অপরের সাথে সংযোগ স্থাপন করব?

হান কাং কোনো সহজ উত্তর দেন না। বরং তিনি আমাদের একটি অনিশ্চিত অবস্থায় রেখে দেন, যেখানে নীরবতাই সবচেয়ে জোরালোভাবে কথা বলে। উপন্যাসের শেষ দিকে এসে আমি ভাবছিলাম, সত্যিকারের মানবিক সংযোগের আসল মানে কী? আমরা কি কখনও পুরোপুরি অন্য কাউকে বুঝতে পারি, নাকি আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকি?

‘গ্রিক লেসনস’ একটি নীরব কিন্তু গভীর চিন্তা উদ্রেককারী উপন্যাস, যা ভাষা, আঘাত, এবং কথোপকথনের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। যারা ভাবপ্রবণ, লিরিক্যাল লেখার ভক্ত, তাদের জন্য এটি একটি অবশ্যপাঠ্য বই। আমি বইটি পড়ে বেশ মর্মাহত হয়েছিলাম, এবং প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় ছিলাম যে কীভাবে এটি আত্মস্থ করব। তবে বইটির নীরবতার সৌন্দর্য আমাকে দীর্ঘদিন ধরে ভাবাবে।

নিজের ভাষাগত অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন ভাবি—ভাষার আনন্দ এবং সীমাবদ্ধতা দুটোই—‘গ্রিক লেসনস’ আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা প্রায়ই কথোপকথনের গুরুত্বকে অবমূল্যায়ন করি। ভাষার মাধ্যমে, ইশারায়, এমনকি নীরবতার মধ্যেও, সংযোগের পথগুলি জটিল এবং গভীর। এটি এমন একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়, যে অনেক সময় যা বলা হয়নি, তাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আশুলিয়ায় পোশাককর্মীকে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা
আশুলিয়ায় পোশাককর্মীকে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা
সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাইকোর্টের রুল
সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাইকোর্টের রুল
রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনে দ্বিমত বিএনপির
রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনে দ্বিমত বিএনপির
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আ.লীগের ১০ নেতাকর্মী গ্রেফতার
রাজধানীতে ঝটিকা মিছিলনিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আ.লীগের ১০ নেতাকর্মী গ্রেফতার
সর্বাধিক পঠিত
আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, বিপাকে পুলিশ
আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, বিপাকে পুলিশ
প্রধানমন্ত্রী নয়, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার চায় এনসিপি: নাহিদ ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী নয়, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার চায় এনসিপি: নাহিদ ইসলাম
যেসব পদক্ষেপে ঘুরে দাঁড়ালো রিজার্ভ
যেসব পদক্ষেপে ঘুরে দাঁড়ালো রিজার্ভ
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ বিব্রতকর: পুলিশ সুপার
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ বিব্রতকর: পুলিশ সুপার
বাংলাদেশ ভ্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা জারি
বাংলাদেশ ভ্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা জারি