‘অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার’ সংক্ষেপে 'ওসিডি'-এর মতো নিষ্ঠুর মানসিক ব্যাধি, ব্যক্তিগত মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক আত্মদর্শনের জটিল সূতোগুলোকে নিয়ে রচিত হারুন আল রশিদের উপন্যাস ‘ওসিডি’ বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য স্বতন্ত্রতার স্বাক্ষর।
‘অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার’ এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ তার নিজের চিন্তা ও বোধের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিরবচ্ছিন্ন দুশ্চিন্তাকে বয়ে নিয়ে চলে। ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেমন উদ্বেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে নিজের অজান্তেই পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করতে বাধ্য হয় এবং নিজের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি আমাদের সমাজও কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি আরোপের তাড়নায় সামগ্রিক সামাজিক কাঠামোর জন্যই আত্মঘাতী হয়ে উঠে। এমন একটি জটিল প্রেক্ষাপট নিয়ে উপন্যাস লেখার চিন্তা অবশ্যই সাহসী এবং হারুন আল রশিদ সন্দেহাতীতভাবে এই প্রেক্ষাপট চিত্রায়ণে সফল হয়েছেন।
উপন্যাসে ‘ওসিডি’ মানসিক ব্যাধির ক্লিনিক্যাল সংজ্ঞাকে অতিক্রম করে একটি বিস্তৃত স্তরে সামাজিক অসুস্থতার রূপক হিসেবে কাজ করে এবং পাশাপাশি এ ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক অবস্থাকে আরো কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেয়। তবে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শিশিরকণা কিংবা হামিদ, রাশেদ, চেয়ারম্যান স্যার, শিশিরকণার মা বা অন্যান্য চরিত্রদের জীবনের গভীর চিত্রায়ণ সত্ত্বেও ‘ওসিডি’ মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রামের চিত্রায়ণের চেয়েও বেশি কিছু; এটি আমাদের অস্তিত্বকে গঠন করে এমন সামাজিক কাঠামোর উপর একটি গভীর ভাষ্য। 'ওসিডি'-কে কেন্দ্রীভূত করে লেখক দারুণ কৌশলের সাথে সামাজিক অসুস্থতার বিস্তৃত প্রকৃতির অন্বেষণ করে গেছেন, সামঞ্জস্যের শ্বাসরুদ্ধকর চাপ থেকে শুরু করে বৈষম্যের কপট ধরা পর্যন্ত। শিশিরকণা, হামিদ বা পাগলের বাহ্যিক শক্তির সাথে তাদের মনের অভ্যন্তরে অবিরত চলতে থাকা যুদ্ধের সংমিশ্রণ চরিত্রগুলোর প্রতি পাঠকের হৃদয়কে আর্দ্র করে তুলে; হারুন আল রশিদের গদ্য লেখনীর গুণেই হোক বা চরিত্রগুলোর মানবিক দুর্বলতার অপরিমার্জিত চিত্রায়ণের কারণেই হোক, খুনি ছিনাল শিশিরকণার প্রতিও অপ্রতিরোধ্য এক মায়া জন্মায়, বাথরুমে আটকে পড়া পাগলের জন্য মন কেমন কেমন করে, ডবকা পাছার হামিদ কিংবা রাশেদের জন্যও করুণা হয় বৈকি! আবার জহিরের প্রতি জন্মায় তীব্র রাগ! আরো একটু কি সাহসী হতে পারতো না সে?
বাংলা সাহিত্যে নায়িকা বা প্রধান চরিত্রকে আমরা যেভাবে দেখে অভ্যস্ত, শিশিরকণা আমাদের সকল স্বাভাবিকতার পূর্ব কল্পিত ধারণার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। না, শিশিরকণার বয়ানে উপন্যাসের গল্প এগিয়ে গিয়েছে বলেই নয় বরং সামাজিক সকল সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তার স্বাধীনতায়, বোধের গভীরতায়, আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হতে পেরেছে বলেই খুনি হয়েও শিশিরকণা নায়িকা। ‘ওসিডি’ শিশিরকণার মনের অস্থির জগতের একটি জানালাস্বরূপ, সেই জানালা দিয়ে আমরা ঠান্ডা মাথার এক খুনিকে যেমন দেখতে পাই, তেমনি জহিরের প্রেমে মগ্ন করুণ এক প্রেমিকাকেও পাই, চেয়ারম্যান স্যার, মোজাম্মেল কিংবা মতিউরের সাথে ছিনালের মতো ছলনা করতে থাকা শিশিরকণাকে দেখতে দেখতে আমরা পাগল মাকে বুকে জড়িয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়ার আকুতিরত অন্য এক শিশিরকণাকেও দেখতে পাই। এইসব বৈচিত্র্যময় অনুভূতির সংমিশ্রণ শিশিরকণাকে দারুণভাবে মানবিক করে তুলে, পাঠক বুঝতে পারে ওসিডি আক্রান্ত একটা সমাজই শিশিরকণাদের জন্ম দেয়। শিশিরকণার মনোজগতের অস্থিরতা মূলত সামাজিক অস্থিরতারই এক নিখুঁত ব্যক্তিগত চিত্রায়ণ।
শিশিরকণা উচ্চশিক্ষিত, ডক্টরেট করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তবুও তার ব্যক্তিগত জীবন গভীর বেদনা এবং অনুশোচনার। পিতামাতার চাপের কারণে তার অনাগত সন্তানকে গর্ভপাত করার সিদ্ধান্ত, সামাজিক নিয়ম এবং পারিবারিক প্রত্যাশার শ্বাসরুদ্ধকর প্রভাব, জহিরের প্রতি তার গভীর ভালবাসা সত্ত্বেও নিজের ইচ্ছাগুলোকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হওয়া, জহিরের খুন হওয়া নিয়ে পরিবারের মানুষের প্রতি সন্দেহ শিশিরকণার মনে বিশ্বাসঘাতকতার দীর্ঘস্থায়ী অনুভূতি তৈরি করে। হামিদের সাথে তার বিয়ে এবং হামিদ কর্তৃক যৌন জবরদস্তির নিরলস আক্রমণ শিশিরকণাকে আরো বেপরোয়া করে তোলে, হামিদের কাছ থেকে মুক্তির জন্য মরিয়া শিশিরকণা হামিদকে খুন করার মাধ্যমে মুক্তি লাভ করতে চায়। তবুও কি মুক্তি মেলে শিশিরকণার? মরে গিয়েও হামিদের ভূত তার পিছু ছাড়ে না। গ্রিক পুরাণের সেই বহুমস্তকবিশিষ্ট সর্প হাইড্রার মতো হামিদের ভূত, অর্থ ও সম্পত্তিলোভী রাশেদ কর্তৃক আরোপিত কলঙ্ক, করিম চাচা বাহার চাচা কিংবা চেয়ারম্যান স্যারের মতো অন্যরকম 'ওসিডি'-তে ভুগতে থাকা মানুষদের নিপীড়নের ধাক্কা শিশিরকণার দিকে ক্রমশ তেড়ে আসে, শিশিরকণা কাস্তে হাতে দাঁড়িয়ে হাইড্রার একটার পর একটা মাথা ক্লান্তিহীনভাবে কাটতে থাকে। হাইড্রার একটা মাথা কাটে তো অন্য আরেকটা গজায়!
ক্লান্ত শিশিরকণা মায়ের কাছে আশ্রয় চায়, যিনি নিজেও 'ওসিডি'-এর সাথে লড়াই করছেন, জহিরের সম্ভাব্য খুনি বা নিদেনপক্ষে খুনের পরিকল্পনায় সাহায্যকারী মায়ের প্রতি প্রেম এবং বিরক্তির এক বেদনাদায়ক প্যারাডক্সের মুখোমুখি হয় শিশিরকণা। কখনো সে তার মায়ের প্রতি গভীরভাবে যত্নশীল, আবার কখনো মায়ের কারণে তার অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া অপরিসীম ক্ষতি, মা আর মায়া খালার যোগসাজশে ঘটে যাওয়া মুক্তি ক্লিনিকের সেই স্মৃতি এবং মায়ের বর্তমান মানসিক অবস্থার কারণে তার প্রতি বিরক্তি শিশিরকণাকে এক অদ্ভুত মানসিক জার্নির মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়। মায়ের প্রতি সমবেদনা এবং ক্রোধের পরস্পরবিরোধী আবেগের সাথে লড়াই করতে করতে নিয়তির নির্মম পরিহাসে মায়ের হত্যার দায় কাঁধে নিয়ে গিলোটিনের নিচে মাথা পেতে দাঁড়াতে হয় তাকে। কেন শিশিরকণার এই দায় বয়ে বেড়ায়? কারা তাকে বাধ্য করে? হামিদের ভূত? নাকি তার আমলা পিতার মিথ্যে লোক-দেখানো ইগো, বা নাভি পর্যন্ত দাড়ি রাখা রাশেদের অর্থলোভ, টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া সোনিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা, কিংবা ক্ষয়ে যাওয়া পচে যাওয়া আমাদের এই নড়বড়ে সামাজিক কাঠামো? পাঠকের জন্য এই ভাবনার জায়গাটা উন্মুক্ত রেখে দিয়েছেন লেখক, অনেকটা সচেতনভাবেই।
ঔপন্যাসিক হারুন আল রশিদ বরাবরই ব্যতিক্রমধর্মী রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের এক স্বতন্ত্র কণ্ঠ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ‘ইউলিসিস’ এর মতো কালজয়ী ক্ল্যাসিকের অনুবাদসহ ‘রেণুর আবির্ভাব’ ও ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’ এর মতো উপন্যাস তার বৈচিত্র্যময় বিষয়ে ভিন্নধর্মী গদ্য রচনার স্টাইলের সাথে পাঠকের মননশীল চেতনার এক অভাবনীয় মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। কথাসাহিত্যকে বাহন করে সামাজিক ও ব্যক্তিগত মানসিক অস্থিরতার আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন করে একটি সংবেদনশীল বিষয়কে শৈল্পিক উপায়ে উপস্থাপনে লেখকের দক্ষতা প্রশংসনীয়। 'ওসিডি'-তে তার গদ্য লেখার ধরণ মন্ত্রমুগ্ধের চেয়ে কম নয়। লিরিক্যাল সূক্ষ্মতার সাথে লেখক গল্পের চরিত্রগুলোর মনের প্রাণবন্ত এক ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছেন, আবেগের একটি ক্যালিডোস্কোপ তৈরি করেছেন যা চূড়ান্ত পৃষ্ঠাটি উল্টানোর অনেক পর পর্যন্ত অনুরণিত হতে থাকে পাঠকের কল্পনায়। উপন্যাসের প্রতিটি বাক্যই এক ধরনের জরুরি তার অনুভূতিতে আবদ্ধ, যা পাঠকদেরকে গল্পের ভেতরে ঘটতে থাকা অস্বস্তিকর সত্যগুলোর মুখোমুখি হতে বাধ্য করে। সতর্কতার সাথে কারুকাজ করা অক্ষরগুলোর মাধ্যমে লেখক হারুন আল রশিদ মানব মানসিকতার বহুমুখী জটিলতার প্রমাণ মেলে ধরেন। গল্পের প্রতিটি চরিত্রই ওসিডি নামক ব্যাধির একটি অনন্য প্রকাশকে মূর্ত করে। হারুন আল রশিদ, মানুষের জীবনকে পরিচালনা করে এমন নিরলস আচার-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের মনকে নিরলস তাড়া করে বেড়ানো চিন্তাভাবনার বহুমুখী চিত্রায়ণের মাধ্যমে এই অপূর্ণ বিশ্বে মানুষ হওয়ার অর্থ কী তা পুনর্মূল্যায়নের দাবি রেখে যান পাঠকের সামনে। একজন পেশাদার কূটনীতিক হওয়া সত্ত্বেও হারুন আল রশিদ সমাজকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সমবেদনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন বলেই হয়ত ‘ওসিডি’-এর মতো ভিন্নধর্মী এই উপন্যাস বাস্তব রূপ পেয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে লেখার জন্য সংবেদনশীলতা এবং অন্তর্দৃষ্টির একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য প্রয়োজন, যা হারুন আল রশিদের লেখায় ভীষণভাবেই প্রত্যক্ষ করা যায়।