X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

হান কাং-এর ‘দ্য হোয়াইট বুক’ থেকে

অনুবাদ : অহ নওরোজ
১১ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:০৮আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:২০

এবার প্রথম কোরিয়ান হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং।১  কাং-এর সাহিত্যজীবন শুরু হয় ‘সিউলে শীতকাল’ কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে—কলেজ জীবনে তিনি কোরিয়ার আধুনিকতাবাদী কবি য়ি সাং-এর কবিতার একটি বাক্যে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন—‘আমি বিশ্বাস করি, মানুষের উচিত উদ্ভিদ হওয়া’; তিনি বুঝেছিলেন, এই বাক্যটি জাপানি দখলদারিত্বের সময় কোরিয়ার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষামূলক মনোভাব প্রকাশ করে—মনে করা হয়, এই ভাবনা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে কাং তার সবচেয়ে সফল উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ লিখে বুকার পুরস্কার জিতেছিলেন। কাং রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৮, তার মধ্যে ৩টি উপন্যাসিকা, ২টি প্রবন্ধ, ২টি ছোটগল্প, ১টি কবিতা এবং বাকিগুলো উপন্যাস। কাং-এর ‘দ্য হোয়াইট বুক’ উপন্যাসের কিছু অংশ দেবোরা স্মিথকৃত ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন অহ নওরোজ।


নবজাতকের গাউন

আমাকে বলা হয়েছিল, আম্মার প্রথম সন্তান জন্মের মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়।

আরো বলা হয়েছিল, নবজাতকটি ছিল মেয়ে, তার মুখ ছিল অর্ধচন্দ্রাকার পুলিপিঠার মতো সাদা। দুমাসের প্রিম্যাচিওর হলেও ছোট্ট মেয়েটির আকার পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছিল। মা বলছিল, যে মুহূর্তে শিশুটি দুটি কালো চোখ খুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে, সে মুহূর্তের কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না।

তখন আমার বাবা-মা গ্রামাঞ্চলে প্রাইমারি স্কুলের কাছে একটি বাড়িতে থাকতো। বাড়িটি লোকালয় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। বাবার চাকুরি ওই স্কুলে। ডাক্তারের কথানুসারে তখন ডেলিভারির দিন অনেক বাকি, ফলে মা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। এক সকালে হঠাৎ তার ব্যথা ওঠে, জল ভাঙে। আশেপাশে কেউ নেই। গ্রামের একমাত্র টেলিফোন বাসস্টপের পাশে একটি ছোট দোকানে—মিনিট বিশেক দূরে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে বাবার আরও ছয় ঘণ্টা বাকি।

শীত তখন সবে শুরু, বছরের প্রথম তুষার পড়তে শুরু করেছে। আমার ২২ বছর বয়সী মা অর্ধশোয়া অবস্থায় পা টানতে টানতে রান্নাঘরে ঢোকে, দুটো কাঁচি জীবাণুমুক্ত করার জন্য কিছু জল ফোটায়, তারপর সেলাইয়ের বাক্স হাতড়িয়ে নবজাতকের গাউন তৈরির জন্য কিছু কাপড় খুঁজে পায়। কাপড়ের রং শ্বেতশুভ্র। একদিকে প্রচণ্ড ভয় আর ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে অন্যদিকে তার হাতের সুঁই চলছে, চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে ঝরঝরিয়ে। ছোট্ট গাউন বানানো শেষ হয়। হাতের কাছে পাওয়া যায় পাতলা একটা কম্বল; ব্যান্ডেজ হিসেবে কাজে লাগবে। যতবার ব্যথা বাড়ে সে দাঁতে দাঁত চেপে রাখে। ব্যথা বাড়ে, আরো তীব্র হয়।

অবশেষে ডেলিভারি হয়। এখনো সে একা, নিজেই নাড়ি কেটে ফেলে। কাঁপতে থাকা রক্তাক্ত ছোট্ট দেহটাকে গাউন পরিয়ে বাহুর ভেতরে জড়িয়ে ধরে। ‘খোদার দোহাই, মরে যেয়ো না’, সরু গলায় মন্ত্রের মতো সে অবিরাম বিড়বিড় করতে থাকে। এভাবে ঘণ্টাখানেক কেটে যাওয়ার পর শিশুটির আঁটসাঁট চোখের পাতা হঠাৎ খুলে যায়। তখনই প্রথম মায়ের সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়। ঠোঁট আবারো কেঁপে ওঠে, ‘খোদার দোহাই, মরে যেয়ো না’। এর প্রায় আরো এক ঘণ্টা পর নবজাতক চলে যায়। তারা রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে থাকে। আমার মা ছোট্ট মৃত দেহটাকে বুকের কাছে তবু জাপটে ধরে রাখে। তার মনে হতে থাকে ধীরে ধীরে মাংসের ভেতর দিয়ে হাড়ের মজ্জায় ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ছে। কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই।


চন্দ্রাকার পুলিপিঠা

গত বসন্তে একটি রেডিওর সাক্ষাৎকারে একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি যখন ছোট ছিলেন তখন কোন অভিজ্ঞতা আপনাকে দুঃখের কাছে এনেছিল?

সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে মায়ের কাছে শোনা এই ঘটনাই আমার মনে এলো। আমি এই গল্পের ভেতরেই বড় হয়েছি। চন্দ্রাকার পুলিপিঠার মতো সাদা ছোট্ট শিশু, সে যেখানে মরে গিয়েছে সেখানেই আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা।

‘চন্দ্রাকার পুলিপিঠা’র অর্থ আমি প্রথম বুঝি মায়ের সঙ্গে চুসেওক উৎসবের জন্য চালের পিঠা তৈরির সময়। তখন আমার বয়স ছয়, পিঠা তৈরিতে সাহায্যের জন্য যথেষ্ট বড় আমি। ময়দা পাকিয়ে ছোট ছোট অর্ধচন্দ্র বানাচ্ছিলাম। ভাপানোর আগে, চালের ময়দার ওই উজ্জ্বল শুভ্র অর্ধচন্দ্রগুলো এত সুন্দর মনে হতো যে, ওগুলো যেন এই পৃথিবীর নয়। কিন্তু যখন সেগুলো থালায় করে চিকন পাইন পাতায় সাজিয়ে পরিবেশন করা হতো, তখন সেই অনিন্দ্য সুন্দর পিঠাগুলো স্বাভাবিক ও সাধারণ খাবারে পরিণত হতো। এরপর পিঠাগুলো যখন তিলের তেলে ভেজে ওঠানো হতো সেগুলো ঝলমল করতো ঠিকই, খেতে সুস্বাদু হতো ঠিকই, কিন্তু হারিয়ে যেত তার জাদুকরী আলো।

এখন বুঝি ‘পুলিপিঠার মতো সাদা’ বলতে মা কী বোঝাতো—চমকে ওঠার মতো একটি অপ্রস্তুত মুখ। এইসব ভাবনাই আমার হৃদয় লোহার মতো কঠিন করে  দিয়েছিল।

গেল বসন্তে রেডিওর সাক্ষাৎকারে এসব কথা আমি বলিনি। এর পরিবর্তে বলেছিলাম আমার পোষা কুকুরের কথা। কুকুরটি পাঁচ বছর বয়সে মরে গিয়েছিল।


তথ্যসূত্র

১ : দ্য গার্ডিয়ান, ১০ অক্টোবর ২০২৪
২ : য়ি সাং-এর এই বাক্য কোন কবিতায় আছে তা জানা যায়নি, তবে কাং তার একাধিক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। —ইন্টারভিউ উইথ কাং বাই সারাই সিন, মার্চ ২০১৬
৩ : রিভিউ অব ‘দ্য ভেজেটেরিয়ান’, চার্লস মন্টগোমেরি, ktlit, ১৫ নভেম্বর ২০১৫
৪, ৫ : চুসেওক উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রধান উৎসব। প্রাক-শরতে ধান কাটার সময় এই উৎসব কোরিয়াজুড়ে উদ্‌যাপিত হয়। এ সময়ে উভয় কোরিয়ায় তিন দিনের ছুটি পালিত হয়। চুসেওক উৎসবের বহুলচর্চিত আচারের মধ্যে চন্দ্রাকার চালের পিঠা তৈরি অন্যতম। [chuseok.org]

মূল : গ্রান্টা সাহিত্য পত্রিকা, ১৪০তম সংখ্যা, প্রকাশিত ৩রা আগস্ট ২০১৭

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত ইমরান খান, সমালোচনার মুখে নরওয়ে
এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন ৩ জন
হান কাং-এর “দ্য হোয়াইট বুক”গভীর দার্শনিক আখ্যান
সর্বশেষ খবর
যশোরে দুপুরে আ.লীগ নেতাদের বাড়ি পুলিশের অভিযান, সন্ধ্যায় ঝটিকা মিছিল
যশোরে দুপুরে আ.লীগ নেতাদের বাড়ি পুলিশের অভিযান, সন্ধ্যায় ঝটিকা মিছিল
‘৫ বছরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে খরচ ২৩০০ কোটি টাকা, ৭০০ কোটিতে নামানো সম্ভব’
‘৫ বছরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে খরচ ২৩০০ কোটি টাকা, ৭০০ কোটিতে নামানো সম্ভব’
গুলশানকে হারিয়ে আরও এগিয়ে গেলো আবাহনী
গুলশানকে হারিয়ে আরও এগিয়ে গেলো আবাহনী
নেপালে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচের অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি
নেপালে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচের অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি
সর্বাধিক পঠিত
আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, বিপাকে পুলিশ
আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, বিপাকে পুলিশ
যেসব পদক্ষেপে ঘুরে দাঁড়ালো রিজার্ভ
যেসব পদক্ষেপে ঘুরে দাঁড়ালো রিজার্ভ
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ বিব্রতকর: পুলিশ সুপার
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ বিব্রতকর: পুলিশ সুপার
বাংলাদেশ ভ্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা জারি
বাংলাদেশ ভ্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা জারি
প্রথম আলোর নিউজটি দিল্লি থেকে লিখে দেওয়া, বললেন হাসনাত আব্দুল্লাহ
প্রথম আলোর নিউজটি দিল্লি থেকে লিখে দেওয়া, বললেন হাসনাত আব্দুল্লাহ