X
বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫
৩ বৈশাখ ১৪৩২

পরশপাথর—মারিও ভার্গাস ইয়োসা

জয়া চৌধুরী
১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৫৩আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৫৩

৮৭ বছর বয়সে ২০২৩ সালে স্পেনের ‘এল পাইস’ পত্রিকায় ‘পরশপাথর’ শিরোনামে মারিও ভার্গাস ইয়োসা একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যেখানে দৈনিক পত্রিকার তরুণ লেখকদের প্রতি তার বার্তা ছিল—'তরুণদের আমি একটাই উপদেশ দিই: সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়র সঙ্গে আপনার বক্তব্য মিলে যাক বা বিরোধিতা করুন আপনার কাজ হলো বলা এবং আপনার সত্যকে রক্ষা করা।'

মারিও ভার্গাস ইয়োসা পেরুর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনিকার। জীবদ্দশায় তার সাফল্য ও খ্যাতি অতুলনীয় উত্তুঙ্গ উচ্চতায় উঠেছিল। ইয়োসার জন্মসাল ১৯৩৬, পেরুর আরেকিপা শহরে। জন্মের কয়েক মাস আগেই বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। নয়-দশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি জানতেনই না যে বাবা জীবিত। মাতৃধারায় তিনি ছিলেন স্প্যানিশ উত্তরাধিকার। সপ্তদশ শতকে পেরুতে নিয়োজিত স্পেনীয় আর্মির এক অফিসার ছিলেন খুয়ান দে লা ইয়োসা। তিনি পরে আরেকিপার একটি নারীকে বিবাহ করেন। সেই বংশের নারী ছিলেন ইয়োসার মা দোরা ইয়োসা। ইয়োসার জীবন সে অর্থে জন্মের আগে থেকেই ঘটনাবহুল। মারিওর বাল্যকাল মামাবাড়িতে কেটেছে। যদিও বছর তিনেক বয়সে মাতামহ বলিভিয়ায় চলে যাওয়ায় সেখানেই তার পড়াশোনার শুরু। তার দশ বছর বয়সে মাতামহ আবার পেরুর পিউরা প্রদেশের প্রিফেক্ট হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে ফিরে এলে মারিওর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ঘটে। এখানেই দশ বছর বয়সে বাবা মায়ের মধ্যে ফের যোগাযোগ তৈরি হয় এবং মারিওর সঙ্গে তার বাবার পরিচয় ঘটে।

লেখা শুরু করেছিলাম সংবাদপত্রে যে তরুণেরা লেখালেখি করে তাদের প্রতি মারিওর উপদেশ নিয়ে। মারিওর নিজের সাংবাদিক জীবন শুরু করেন পড়াশোনা চলাকালীন লিমার সবচেয়ে বিখ্যাত পত্রিকা লা ক্রোনিকায়। পরবর্তীকালে আরেক পত্রিকা লা ইন্দুস্ত্রিয়ায়। মারিওর বিভিন্ন লেখায় যে সহজ অনুসন্ধিৎসু একটি দৃষ্টিভঙ্গির ধারা দেখি, আমার মনে হয় লেখালেখির শুরুতেই সাংবাদিকতার পাঠ নেওয়ায় সেটির ছাপ পড়েছিল। সমস্ত শৈশব ও বয়ঃসন্ধি তার কেটেছে মায়ের পরিবারের প্রতি তার বাবার অসন্তোষ ও অপছন্দের মানসিকতার দোলাচলের মধ্যে। মারিওর মনের গঠনে বিশেষ ছাপ ফেলেছিল বাবা-মায়ের দ্বন্দ্ব। ১৪ বছর বয়সে তার বাবা চার বছরের জন্য মিলিটারি একাডেমিতে তাকে ভর্তি করেন। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস La ciudad de los perros  বা কুকুরদের শহর-এ এই সময়কার অভিজ্ঞতারই জীবন্ত ছাপ দেখা যায়। তার সেই মিলিটারি একাডেমিতে পড়ার সময় অধ্যাপকদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত ফরাসি সুররিয়ালিস্ট কবি সেসার মোরো। আর্জেন্টাইন মহান সাহিত্যিক কোর্তাসার যেমন ফরাসি ভাষাতেই জীবিকা নির্বাহ করেছেন বহু বছর। তিনি ইউনেস্কোর স্বীকৃত ফরাসি অনুবাদকের চাকরি করতেন। মারিও ভার্গাস ইয়োসা কিন্তু তেমন নন। তিনি অসাধারণ ফরাসি জানতেন যদিও সে ভাষায় কখনও লেখেননি। এবং একটিও বই ফরাসি ভাষায় না লিখে তিনিই প্রথম লেখক যিনি বহু বছর পরে ২০২১ সালে ফ্রেঞ্চ একাডেমির মনোনীত সদস্য হন। সর্বার্থেই এটি এক অনন্য স্বীকৃতি।

আসলে মারিওর বিপুল বিস্তৃত জীবন ও লেখালেখির কথা একটি লেখায় তুলে ধরা আমার পক্ষে খুবই কঠিন। সারা জীবনে যত উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ লিখেছেন তার কোনোটিই আমার অনুবাদ করা হয়নি। আমার সরাসরি অভিজ্ঞতা অনেকটাই তার সলতে পাকানো পর্বের সময়কার। ১৯৫৯ সালের মধ্যে মাত্র ছয়টি গল্প লিখেছিলেন। সেগুলোকেই অনুবাদ করেছিলাম বহু বছর আগে। এই লেখাগুলোর উপাদান দেখা যায় প্রথম উপন্যাস কুকুরদের শহর-এ। একটি মিলিটারি একাডেমির ছাত্রদের যে নিষ্ঠুর চালচলন আর পেরুর সমাজ-ব্যবস্থা নিয়ে তীক্ষ্ণ সমালোচনা ছিল উপন্যাসটির বিষয়বস্তু। 

বারবার তিনি পেরুর আনাচকানাচ থেকে তুলে এনেছেন উপন্যাসের বিষয়বস্তু। এবং মূলত রাজনৈতিক দৃষ্টিই ছিল তার ভাবনার কেন্দ্রে। এই রাজনৈতিক দর্শন তাকে তাড়িত করে সমস্ত সাহিত্য জীবন। ৮৭ বছর বয়সে তিনি ঘোষণা করেছিলেন তার কুড়িতম উপন্যাসকে শেষ উপন্যাস বলে। সেটির নাম— Le dedico mi silencio বা  আমার নীরবতা আপনাকে উৎসর্গ করলাম। তীক্ষ্ণ এই সমাজবিদ রাজনৈতিক দার্শনিককে আপনি কীভাবে এড়িয়ে যাবেন যদি সমসাময়িক পৃথিবীর রাজনৈতিক অবস্থানটি বুঝতে চান? আরও আশ্চর্য এই উপন্যাসটির লেখার অস্ত্রটি পড়লে। সেটি হলো সঙ্গীত। সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিচ্ছেন। শিল্প কীভাবে জাতীয় চরিত্রকে বেঁধে দেয় তারে সেটির প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাই এখানে। বিষয়বস্তু কিন্তু সেই এক। পেরুর সামাজিক কাঠামোর অবনমন এবং তা থেকে উত্তরণের পথ। তিনি সুর বেঁধেছেন ক্রিওইয়ো ওয়ালতজ সঙ্গীতকে প্রেক্ষাপটে রেখে। ক্রিওইয়ো অর্থে যে স্পেনীয় মানুষ লাতিন আমেরিকায় জন্মেছেন। মানুষই শুধু নয় তার সংস্কৃতি সঙ্গীত নৃত্য সব কিছুই এর মধ্যে পড়বে। পেরুর জাতীয় সঙ্গীত আত্মা হিসাবে এই ক্রিওইয়ো সঙ্গীতকেই বোঝানো হয়। মারিও তার অতি বৃদ্ধ বয়সে লেখা এই উপন্যাসে তরুণ এক গিটার বাদক লালো মোলফিনোকে নিয়ে জাল বুনেছেন অভ্যস্ত ভঙ্গিতে। এটির প্রসঙ্গে তিনি এক সাক্ষাৎকারে একথাও বলেছেন যে “এখানে উপন্যাসটি লেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার একটি গোপন প্রেমের কথাও স্বীকার করে যাই, সেটি হলো ওয়ালতজ সঙ্গীত, বিশেষ করে আমার দেশের ক্রিওইয়ো ওয়ালতজ সঙ্গীতের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসার কথা"। এটি পড়েও মনে পড়ে যায় আবারও কোর্তাসারের কথা। কোর্তাসারের লেখা সেই প্রবল আলোচিত উপন্যাস El perseguidor  বা অনুসরণকারী-র কথা। এটিও অনুবাদ করার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে মূল চরিত্র ছিলেন বাস্তবের জ্যাজ শিল্পী জিমি কার্টার ও তার স্যাক্সোফোন।

মারিওকে নিয়ে আমি বারবার ভেবেছি যে রাজনীতি যার সারাজীবনের লেখার মূল কেন্দ্রে রইল তিনি মানুষটি কি আদপেই প্রেমিক ছিলেন? রাজনীতি নিয়ে তার অদম্য আগ্রহের ফলশ্রুতি একবার তাকে পেরুর রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হিসাবেও দাঁড় করিয়েছিল। সেটা ১৯৯০ সাল। মুশকিল হলো বিপক্ষে ছিলেন আলবের্তো ফুজিমোরি। যিনি Cambio 90  অর্থাৎ ’৯০-এর পরিবর্তন দলের প্রতিষ্ঠাতাও বটে। ফুজিমোরি নির্বাচনে তাকে পরাজিত করে পরবর্তী দশ বছর পেরু শাসন করেন। মারিও কমিউনিস্ট ছিলেন না শেষ অবধি। কিউবার বিপ্লব সংঘটিত হলে ঘোষিত বামপন্থার প্রতি তার মোহভঙ্গ হয়। অথচ তার সারাটা জীবনই কাটল মানুষের সমাজ গঠনের চিন্তায়, জনকল্যাণের ভাবনায়। বামপন্থার লিখিত রূপ কী তা পড়া নেই কিন্তু মানুষের কল্যাণের কথায় যিনি জীবনপাত করেন তাকে আমি বামপন্থী বলেই ভাবি। সারাজীবন পেরুই ছিল তার মূল ভাবনা। যদিও ১৯৮১ সালের উপন্যাস La Guerra fin del mundo বা দুনিয়ার শেষ যুদ্ধ, ২০০০ সালে লেখা La fiesta del Chivo  বা পাঁঠাদের উৎসব  কিংবা ২০১০ সালে লেখা El sueno de Celta  বা সেলতার স্বপ্ন— এগুলির পটভূমি অন্য দেশসমূহ। কিন্তু আখেরে সবকিছুতেই মানব কল্যাণের ভাবনাই ছিল উপন্যাসের উপজীব্য। 

বরং আঘাত লেগেছিল ব্যক্তিগতভাবে জেনে যখন তিনি তার ৪২ বছরের দাম্পত্য ভেঙে বেরিয়ে গেলেন। তার তুতো বোন পাট্রিসিয়ার সঙ্গে ৫০ বছরের দাম্পত্য সম্বন্ধ কীভাবে ভাঙল জানা নেই। কিন্তু সম্বন্ধ হয়েছিলও ৬০-এর দশকে। তখন মারিও ইতোমধ্যেই তার রাজনীতিক মাসি খুলিয়া উরকিদি-এর সঙ্গে দাম্পত্যে ছিলেন। এই খুলিয়াই কিন্তু তার জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস La tia Julia y el escribidor  বা খুলিয়া মাসি ও কলমজীবী  উপন্যাসের মূল চরিত্র। যখন পাট্রিসিয়ার সঙ্গে সম্বন্ধ হয় তখন তার আত্মীয়স্বজন মেনে নিতে পারেনি। যদিও পরে খুলিয়ার সঙ্গে ডিভোর্স হয় ও পাট্রিসিয়াকে বিবাহ করেন। এমনকি নোবেল পদক জয় করার সময়ও মারিও পাট্রিসিয়াকে তার সারা জীবনের কাজের অকুণ্ঠ সমর্থক হিসাবে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে সোশালাইট ইসাবেল প্রেইসলারের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়। এবং তাদের ৫০ বছরের দীর্ঘ দাম্পত্য ভেঙে যায়। কিন্তু এই সম্পর্কটিও ২০২২ সালে ভেঙে যায়। তখন কথা ওঠে তবে কী পাট্রিসিয়ার সঙ্গে আবার বোঝাপড়া হবে? হ্যাঁ, শেষ অবধি তিনি পাট্রিসিয়া ও তিন সন্তানের সঙ্গেই থেকে গেলেন আমৃত্যু।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রোমাঞ্চকর ড্রয়ে বায়ার্নকে বিদায় করে সেমিফাইনালে ইন্টার
রোমাঞ্চকর ড্রয়ে বায়ার্নকে বিদায় করে সেমিফাইনালে ইন্টার
রিয়ালকে হারিয়ে ১৬ বছর পর সেমিফাইনালে আর্সেনাল
রিয়ালকে হারিয়ে ১৬ বছর পর সেমিফাইনালে আর্সেনাল
ঐতিহাসিক ১৭ এপ্রিল দিবস উপলক্ষে প্রস্তুত মুজিবনগর
ঐতিহাসিক ১৭ এপ্রিল দিবস উপলক্ষে প্রস্তুত মুজিবনগর
স্টার্কের দারুণ বোলিংয়ে সুপার ওভারে রাজস্থানকে হারালো দিল্লি
স্টার্কের দারুণ বোলিংয়ে সুপার ওভারে রাজস্থানকে হারালো দিল্লি
সর্বাধিক পঠিত
পরীক্ষা শুরুর ২০ মিনিটের মধ্যে ফেসবুকে এসএসসির প্রশ্ন
পরীক্ষা শুরুর ২০ মিনিটের মধ্যে ফেসবুকে এসএসসির প্রশ্ন
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মার্কিন অর্থায়ন বাতিলের প্রস্তাব
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মার্কিন অর্থায়ন বাতিলের প্রস্তাব
দুদকের অভিযান দেখে পালালেন জেলা রেজিস্ট্রার, বললেন ঢাকার পথে আছি
দুদকের অভিযান দেখে পালালেন জেলা রেজিস্ট্রার, বললেন ঢাকার পথে আছি
ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি বানানো শিল্পীর বাড়িতে আগুন
ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি বানানো শিল্পীর বাড়িতে আগুন
উজানে ‘মেগা ড্যামের’ ধাক্কা সামলাতে দিল্লি-ঢাকা-থিম্পুকে জোট বাঁধার ডাক
উজানে ‘মেগা ড্যামের’ ধাক্কা সামলাতে দিল্লি-ঢাকা-থিম্পুকে জোট বাঁধার ডাক