লেখকের জন্য ছদ্মনাম শুধু নিজেকে আড়াল করার জন্যই প্রয়োজন হয় না, অনেক সময় নিজের অপছন্দের নামটিকে ঢেকে রাখার জন্যও লাগে। ছদ্মনাম ধারণের নেপথ্যে কার কী উদ্দেশ্য থাকে সেটা পাঠক হিসেবে আমাদের জানার কথা নয়।
গোলাম আলি লিখতেন নিশাত চৌধুরী ছদ্মনামে। নব্বইয়ের দশকে ইমদাদুল হক মিলনের পাশাপাশি তিনিও প্রেমের উপন্যাস লিখতেন। মাপা মাপা পাঁচ থেকে ছয় ফর্মার বই একেকটি। আমিও শৈশবে তার লেখা চটুল কিছু বই পড়েছি। বইয়ে ছবি থাকত না। একপর্যায়ে তিনি ফ্ল্যাপে ছবি ব্যবহার শুরু করেন। তারপর থেকে বই বিক্রিতে মারাত্মক ধস নামে। পাঠক নারী ভেবেই তার বই কিনত, তিনি যে পুরুষ এটা জেনেই বোধকরি আকর্ষণ কমে যায়! প্রচ্ছদে নিশাত চৌধুরী লেখা থাকলেও ফ্ল্যাপের ছবির নিচে বর্ণনা থাকত তিনি যে গোলাম আলি থেকেই নিশাত চৌধুরী হয়েছেন।
বই বিক্রি না হলে এমনিতেই লেখকের মৃত্যু ঘটে। ধীরে ধীরে লেখক হিসেবে হারিয়ে যান গোলাম আলি তথা নিশাত চৌধুরী। জনপ্রিয় ধারার ঔপন্যাসিক হিসেবে তার ৮০ পৃষ্ঠায় লেখা উপন্যাসগুলো আর চোখে পড়ে না। সিনেমার নায়িকারা বিয়ে করলে খবরটা গোপন রাখতে হয়। নইলে দর্শক কমে যায়। কমার 'যৌক্তিক' কারণ হয়ত আছে। পোড়খাওয়া দর্শক হয়ত ভাবে নায়িকার শরীর-মন সব আমার। তাই নায়িকা বিয়ে করলে এদের 'মালিকানা' হাতছাড়া হয়ে যায়। কিন্তু লেখকের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ব্যাখ্যাটা কী? প্রায় একই অবস্থা যে লেখকের ক্ষেত্রে হতে পারে, বই বিক্রিতে লেখকের লিঙ্গ পরিচয়ও বড় হয়ে ওঠে—জানা ছিল না। গোলাম আলির বিষয়টা সেদিন বললেন কথাসাহিত্যিক জিল্লুর রহমান শুভ্র। তিনি একসময় জিল্লুর রেহমান নামে লিখতেন। এই নামেই পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে পৃথক খণ্ডের একাধিক উপন্যাস ও পরে উপন্যাসসমগ্র প্রকাশিত হয়েছিল।
মোজাম্মেল হক মিলু কবিতা লেখেন অচিন্ত্য চয়ন নামে। পাবনায় মজিদ মাহমুদের জন্মদিন অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে আমরা কয়েকজন গেলাম। সেখানে এলেন লেখক ও শিক্ষক আখতার জামান। মিলু ভাইয়ের প্রকৃত পরিচয় জেনে বলে উঠলেন, ‘ধুর মিয়া, আগে কইবেন না! আমি তো আপনাকে দাদা দাদা ডেকে অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম!’
বর্তমানে যারা ‘ওয়েস্টার্ন' লেখেন তাদের অন্যতম মাসুদ আনোয়ার। একটা সময়ে আমার ধারণা ছিল কাজী আনোয়ার হোসেনই এই ছদ্মনামে লিখছেন। এমন ধারণা পোষণ করেছি দীর্ঘদিন। বই বা পত্রপত্রিকায় একই নাম ঘুরেফিরে বারবার দেওয়া যায় না। তাই দরকার পড়ে ছদ্মনামের আড়াল। যেমন আহসান কবির আলপিনে প্রায়ই প্রচ্ছদরচনা লিখতেন। লেখার পরিমাণ বেড়ে গেলে তিনি নাম ধারণ করতেন কবির মুনাদ। কাজী আনোয়ার হোসেনের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটতে পারে। মাসুদ রানা সিরিজের জনক মাসুদ আনোয়ার নামে লিখতেই পারেন—এটাকে খুব স্বাভাবিক ঘটনা ভেবে নিয়েছিলাম। এই নামের মাধ্যমে সৃষ্টি ও স্রষ্টা একই কাতারে নেমে আসেন। অনেক পরে গিয়ে জানলাম মাসুদ আনোয়ার পেশায় সাংবাদিক। নামটা তারই, কাজী আনোয়ার হোসেনের নয়!
নব্বইয়ের দশকে দৈনিক ভোরের কাগজ থেকে ক্রোড়পত্র হিসেবে প্রকাশিত হতো অবসর নামের ম্যাগাজিন। একবার গোয়েন্দা চরিত্র মাসুদ রানাকে নিয়ে পাঠক সংখ্যা প্রকাশিত হলো। পাঠকরা লিখলেন তাদের পঠন-পাঠন বিষয়ে। মাসুদ রানা কেন তাদের কাছে দিন বদলের নায়ক। একজন পাঠক সেখানে লিখলেন— ‘প্রিয় লেখক মাসুদ রানা রচিত আনোয়ার হোসেন বইটা পড়ে প্রভূত আনন্দ পেলাম!’ থ হয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণ।
নাম বিভ্রাটের আরও (ইতিবাচক) নজির আছে ‘অবসর'-এ। সেখানে টুকরো কার্টুনও ছাপা হতো। বিশ্বকাপ ফুটবল সিজনে এমন একটা কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল; যেখানে বাবা তার মেয়েকে বলছেন, ‘মা কান্নাকাটি করছিস কেন? কে যেন তোকে মাল দেয় নাই?’
সংলাপ বক্সের তরুণী মেয়ের উক্তি যাচ্ছে— ‘চুপ করো তোমরা, মালদিনি নাই!’ অনেক পরে জেনেছি, পাওলো মালদিনি জনপ্রিয় একজন ফুটবল খেলোয়াড়। তিনি ছিলেন তখনকার মেয়েদের ক্রাশ। খেলা থেকে ক্রাশ বাদ পড়লে আমাদের বঙ্গ-ভগিনীদের নাওয়া-খাওয়া বাদ যাবে—এটা আজব-গুজব কোনোটাই নয়!
দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় সম্পাদকের নামে যে-সব লেখা প্রকাশিত হয়, তার সবই সম্পাদক মহোদয় লেখেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধঃস্তনরা লেখেন আর সম্পাদক নিজের নামে ছাপিয়ে দেন। সেটা বিশেষ লেখা হোক কিংবা সম্পাদকীয় মন্তব্য। অধস্তন কর্মীদের চাকরির অংশই এটি। তো একবার বইমেলায় একজন সম্পাদকের কলাম সমগ্র প্রকাশিত হলো। বইমেলার প্রথম সপ্তাহে সম্পাদক গেলেন স্টলে। গিয়ে দেখলেন কোথাও একটা মাছিও বসেনি। পরদিন তার কাগজে বইমেলার সংবাদে প্রকাশিত হলো, সম্পাদককে দেখে লোকজনের ভীড় লেগে যায়। ক্রেতা-দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। অটোগ্রাফ শিকারিদের আবদারও লেখক-সম্পাদক হাসিমুখে মিটিয়েছেন।
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। সেটা আর হলো না। মাস জুড়ে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা কার্যালয়ের কর্মীরা টিপ্পনী কেটে গেল ‘দাদার লেখা স্যারের বই' বলে। মূল লেখক তালুকদার কবি হিরণ্ময় হিমাংশু এক্ষেত্রে মুচকি হাসা ছাড়া আর কীইবা করতে পারেন!
হাসান আজিজুল হকের বাড়ির নাম উজান। রাজশাহীর বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটিতে (বিহাস) গিয়ে আবিষ্কার করলাম নামফলকটা বাড়ির গেটের ভেতরে। অথচ আমরা ঠিকানা চিনি বাইরের নামফলক দেখে। রফিকুর রশীদ, আবদুল্লাহ আল আমিন, রণজিৎ সরকার ও আমাকে সাক্ষাৎ পরবর্তী বিদায়ে এগিয়ে দিতে বাইরে এলেন স্যার। তখন খেয়াল করলাম বিষয়টা। নামফলক বাড়ির নামটা ভেতরে কেন জিজ্ঞেস করতেই হা হা করে হাসলেন হাসান আজিজুল হক— ‘বাইরে রাখলে চোরেরা যদি খুলে নিয়ে যায়!’ আমার পাশে থাকা অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশীদ সায় দিলেন এমন হাস্যরসপূর্ণ যুক্তিতে— ‘স্যারের বুদ্ধি আছে!’ আশির দশকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় টাকা দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশের চল ছিল। যেমন: ত্রিশ শব্দ হলে অত টাকা, তার চেয়ে বেশি শব্দ হলে টাকার অঙ্ক আরেকটু বাড়ত। কবি পুলক হাসান আশির দশকেরই। তখন আরেকজন পুলক হাসান বিচিত্রায় টাকা দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেন। শব্দ প্রতি হিসাবে তিনি কবিতা লিখতেন। তসলিমা নাসরিনসহ আজকের আরও খ্যাতিমান লেখকও এমন পন্থা অবলম্বন করে বিচিত্রায় ‘লিখতেন’।
লিটল ম্যাগাজিন খেয়া সম্পাদক পুলক হাসানকে দেখে একদিন একটা অফিসের লোকজন বলে ওঠে— ‘এই লোকটা অশ্লীল ভাষায় কবিতা লেখে!’ অথচ তিনি বিজ্ঞাপন দিতেন না, ওই বিজ্ঞাপন-কবিতা পড়েনওনি কখনো।
অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিনে শুচি সৈয়দের কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ লিখবেন সুমন শাম্স। বইয়ের দুষ্প্রাপ্যতায় তাকে পিডিএফ পাঠালাম। পাঠানোর পর সুমন শাম্স কল দিয়ে বললেন, ‘ভাই, হাসছিলাম এতক্ষণ যাবৎ। আমি ভেবেছিলাম তিনি (শুচি সৈয়দ) নারী!’
নাম নিয়ে এমন বিভ্রাট কম হয় না। প্রথম আলোর অর্থনীতি বিভাগে কাজ করতেন সুপ্রীতি ধর নামে একজন সাংবাদিক। একদিন কার্যালয়ে গিয়ে একজন অতিথি বলে বসলেন, ‘সুপ্রীতি মেয়েটাকে তো কখনো দেখলাম না!’
শ্রোতারা হাসলেন এমন লিঙ্গ-বোকামিজনিত কৌতূহলে!
শৈশবে পত্রিকা খুললে একজন ছড়াকারের ছড়া দেখতে পেতামই। তিনি জগলুল হায়দার বাবু। পড়তে পড়তে হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, ডাকনাম বাবু আর ছাপা হচ্ছে না। (প্রথম আলো পত্রিকা তখনো ডাকনাম ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্তে আসেনি)। আরেকজন বাবু, কাদের বাবু সম্পাদিত ম্যাগাজিন টিনটিন-এর এক সংখ্যায় প্রকাশিত বইয়ের বিজ্ঞাপনে পেয়ে গেলাম জগলুল হায়দার বাবুর মোবাইল ফোন নম্বর। কল দিলাম তার নম্বরে। প্রশ্ন করলাম— আপনার ‘বাবু'টা কই?
জবাবে ছড়াকার বললেন, বিয়ে করেছি। এখন আমার নিজেরই বাবু আছে। তাই নিজের ‘বাবু'টা লিখি না আর!
তার মানে নামেরও ছোট-বড় বয়স আছে!
ওই সময়ে আলপিন, বন্ধুসভাসহ ফিচার আয়োজন ছাড়াও অন্যান্য কাগজে লিখতেন খায়রুল আলম বাবু। একদিন লক্ষ করলাম তিনি লিখছেন খায়রুল বাবুই নামে! এই দুই বাবু আবার পরে জড়ো হয়েছে কাদের বাবুর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বাবুই'-এ। পৃথক সময়ে তিন বাবুরই বই প্রকাশিত হয়েছে ওই প্রকাশনা থেকে!
বান্দরবানের কেওক্রাডং চূড়ায় নিজেদের পদধূলি ফেলে আসার মানসে যাত্রা শুরু করলাম আমরা পঞ্চপাণ্ডবের দল। লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. মাসুদুল হকও আছেন সঙ্গে। ওখানে সরাসরি কোনো গাড়ি যায় না। থেমে থেমে, গাড়ি পাল্টে তবেই যেতে হয়। রুমা নামক জায়গার ডাকবাংলাতে ছিলাম আমরা একরাত। এখানে ‘নামক' শব্দটা বাহুল্য। লিখতে পারতাম ‘রুমার ডাকবাংলো', তাতে কেউ কেউ ধরে নিতেন রুমা একজন নারীর নাম। তার ডাকবাংলো আছে, সেখানে ছিলাম। আদতে বান্দরবানের একটা জায়গার নাম রুমা! গাড়ি-ঘোড়ার (সমুদ্র এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও ঘোড়া পাইনি। তাও সেটা দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মতো। সখের রাইডিং। ছবি তোলার পোজ দেওয়া ছাড়া আর কিছু তো নয়। অথচ লোকজন এখনো বিকল্প বাহন হিসেবে ঘোড়া ব্যবহার করছে—এমন দাবিই করে আকছার!) দুষ্প্রাপ্যতায় সকালে একটা ট্রাক পাওয়া গেল। ওটা বগালেকে যাবে। অন্য অনেক যাত্রীর মতো আমরাও উঠে পড়লাম। এই ট্রাক আমাদের কিছুটা পথ বাড়তি এগিয়ে দিল। যেহেতু বেশি জায়গা পর্যন্ত বয়ে এনেছে পরিবহনকর্মী বাড়তি ভাড়া দাবি করতেই পারে। মাসুদুল হক স্যার দিলেন নির্ধারিত ভাড়াই। কন্ডাক্টর বাড়তি ভাড়া চাইলে স্যার তাকে ডেকে নিলেন আড়ালে। অন্যদের কান বাঁচিয়ে বললেন, ‘তোর ড্রাইভারকে গিয়ে বল, আমি ড. মাসুদুল হক!’
অল্প দূরত্বে থাকায় কথাটা শুনে ফেললাম। আমরা না হয় লেখক বলে তাকে সম্মান করি, কিন্তু পরিবহনকর্মীরা কেন করবে! অবশ্য এতেই কাজ হলো। কন্ডাক্টর নীরবে গিয়ে চালকের পাশের আসনে বসে পড়ল। মুখে বলল না কিছুই। ট্রাক ছুটলে পরবর্তী গন্তব্যে!