X
সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২

নিসর্গ ও প্রেমের কবি

গাউসুর রহমান
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩:৪৭আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩:৪৭

আল মাহমুদের কবিতার অবয়ব আলাদা, স্টাইল আলাদা। প্রকাশভঙ্গি আলাদা। তিনি চিরকালের বাংলা কবিতার একজন মৌলিক কবি। দশকওয়ারি বিভাজনে তিনি পঞ্চাশের দশকের কবি। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে : লোক-লোকান্তরে, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, প্রহরান্তরের পাশ ফেরা, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, মিথ্যেবাদী রাখাল, আমি দূরগামী, বখতিয়ারের ঘোড়া, দ্বিতীয় ভাঙন, নদীর ভেতরে নদী, উড়াল কাব্য, বিরামপুরের যাত্রী, বারুদগন্ধী মানুষের দেশে, তুমি তৃষ্ণা তুমিই পিপাসার জল, অদৃষ্টবাদীদের রান্না-বান্না ইত্যাদি।

আল মাহমুদ ত্রিশের কবিদের উত্তরাধিকার কম-বেশি বহন করলেও তিনি কিছুতেই ত্রিশের কবিদের মানস সন্তান নন। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ একটা পর্যায় পর্যন্ত ত্রিশের কবিদের বিশেষত জীবনানন্দ দাশের প্রভাবজাত, মানস সন্তান। যদিও তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই ত্রিশের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে হতে পেরেছেন স্ব-চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এক পর্যায়ে আল মাহমুদ কবিতায় নতুনতার ধারা প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। আল মাহমুদ গোড়া থেকেই অনেকটা আলাদা- স্বদেশ, সমাজচেতনা ও লোকমানসের ব্যাপক ও রূপক ঐতিহ্যের সার্থক রূপকার হিসেবে তাঁর মৌলিকত্ব প্রশ্নাতীত।

আল মাহমুদের প্রেমিকসত্তাও প্রবল। তাঁর প্রেম ও সৌন্দর্যের অভিসার কবিতাকে দিয়েছে নান্দনিক দ্যুতি। প্রেমের শারীরীরূপ ও সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে আল মাহমুদের কবিতায়। এ প্রসঙ্গে আল মাহমুদের নিজের বক্তব্য হচ্ছে : “ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় কবির অসহায়তা, জীবিকার অনিশ্চয়তা অন্যান্য কবির মতো আমাকেও কোথাও স্থিরভাবে দাঁড়াতে দেয়নি। আর আমি তো জন্মেছি পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্রতম দেশে। কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে এর প্রতিকার চিন্তায়।”

আমাদের মানতেই হবে, এই প্রতিকার চিন্তাটি কখনোই সম্পন্ন হয় না। ফলে নিজ দেশ, নিজের মাটির প্রতি তাঁর অনুরূপ অকৃত্রিম এবং দেশ ও জাতির সংকটে তিনিও হয়ে উঠেন উদ্বিগ্ন, অঙ্গীকার ও আত্মপ্রত্যয়ে উজ্জ্বল। এ সত্যটি কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না যে, ‘সোনালী কাবিন’ বাঙালি সংগ্রামী মানুষের প্রত্যয়ী উচ্চারণ। তাঁর কবিতার মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠীর মানস-প্রতিবেশ, প্রেম-দ্রোহ, প্রাকৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক, বৈরিতা বিশেষভাবে ভাষা পেয়েছে। এসব বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে কবির অবস্থানও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কবিতায়। ভাবলে অবাক হতে হয়, আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় বাঙালির চিরায়ত সংগ্রামের সঙ্গে বৈশ্বিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের উজ্জ্বল মাত্রা ও আয়তন যুক্ত করেছেন আপন কাব্যিক নিষ্ঠায়।  যা মার্কসবাদী চেতনা ও মার্কসবাদী কবিদের জীবন-অন্বেষণ ও কাব্যদর্শনের সমগোত্রীয়। যদিও আল মাহমুদ মার্কসবাদের দীক্ষিত ছিলেন না। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো : বাংলা কাব্যে সুকান্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায় মার্কসবাদী দর্শন নিয়ে যতটা না কাব্যিক পরিণতি পেয়েছেন; আল মাহমুদ পেয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। এ কথা বলাও অত্যুক্তি হবে না যে, মার্কসীয় দর্শনকে কবিতায় ব্যবহার করে আল মাহমুদই বাংলা কবিতায় সর্বমাত্রিক সাফল্য দেখিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর সার্থক পূর্বসূরি কিংবা সার্থক উত্তরসূরিও নেই। আর আল মাহমুদ আলোচ্য প্রেক্ষিতে একক ও অনন্যা। সাম্যবাদী চেতনার প্রতি তাঁর পক্ষপাত কোনোভাবেই অস্পষ্ট নয়। বাংলা কবিতার আধুনিকতাকে ত্রিশের কবিদের পর শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদই সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত করেছেন। এই কবি তাই সহজেই উচ্চারণ করতে পারেন: 

১। পূর্ব পুরুষের ছিল পাট্রিকেরা, পুরীর গৌরব।

২। বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী।

৩। তোমার শরীরে যদি থাকে শস্যের সুবাস।

আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় বক্তব্য অনুসারে নতুন, অভিনব ও সার্থক ভাষারীতির প্রয়োগ দেখিয়েছেন। পাঠক যখন আল মাহমুদের কবিতা নিবিড়ভাবে পাঠ করেন, তখন অনুধাবন করতে সক্ষম হন যে, প্রথমদিকে আত্মসংকট ও নেতিচেতনা তাঁকে আমূল নিমজ্জিত করতে চাইলেও তিনি তা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। ‘লোক-লোকান্তর’ কাব্যে নৈরাশ্য, নৈঃসঙ্গ্য, অবক্ষয়, ক্ষোভ, দ্রোহ, ক্রোধ, বিচ্ছিন্নতাবোধ, বেদনার আর্তি কিংবা শূন্যতাবোধ ছায়াপাত করলেও এসব তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। আত্মরক্ষার কৌশল ও যোগ্যতা নিয়েই বাংলা কবিতার সজল সমুদ্রে পানসি সাজিয়েছেন তিনি। কবি লেখেন:

“মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে

মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;

আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেদাম জেহাদ বলে জেগে উঠি।”

জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে।

যেন বালিশে মাথা রাখতে চায় না এ বালক,

যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে মশারি,

মাতৃসন্তানের পাশে দু’চোখ কচলে উঠে দাঁড়াবে এখুনি:

বাইরে তার ঘোড়া অস্থির, বাতাসে কেশর কাঁপাচ্ছে

আর সময়ের গতির ওপর লাফিয়ে উঠেছে সে।

না, এখনও সে শিশু

মা তাকে ছেলে ভোলানো ছড়া শোনায়।

বলে বালিশে মাথা রাখোতো বেটা,

শোনো

বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।

আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি।

হাতে নাঙ্গা তলোয়ার।”

[‘বখতিয়ারের ঘোড়া, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’]

আল মাহমুদের কবিচৈতন্যের আর্তিকে একটি বিহঙ্গের মুখোশ উড্ডীন বলে মনে হয়। সৌষম্য বোধের অভাব নেই তাঁর কবিতায়। ফলে সমসাময়িক অনেক কবির মতো বাধাহীন বাতাসের মতো হত্যা করেন না নিজেকে। সৌষম্যবোধে ধনী এই কবির কাব্য এষণা স্বনির্ভর। আজকের দিনে সম্পূর্ণ মৌলিক কবির সাক্ষাৎ লাভ- এক কথায় প্রায় অসম্ভব। কারণ তাঁর চারদিকে অসংখ্য পূর্ব পুরুষ দাঁড়িয়ে থাকে সিঁড়ির মতো। তারপরও ভাষা ও জিজ্ঞাসায়, রহস্যময়তায় আজকের দিনেও একজন মৌলিক কবির আবির্ভাব সম্ভব। পঞ্চাশের দশকেও অমিত সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন আল মাহমুদ। তিনি ভাবনা-বেদনায় আধুনিক। মনন ও চৈতন্যের বিবাহে তিনি তাঁর মানস-সরোবরে চেতন-অবচেতনের প্রত্ন-নব্য কোলে ও স্মৃতি-দ্বন্ধের সচল সৃজনীতে নিজেকে সঁপেছেন। তাঁর কবিতায় সমাজ ও ব্যক্তি-সত্তার অব্যর্থ সংগম ঘটেছে বর্ষণবিদ্ধ চৈতন্যের হু-হু মাঠে। গ্রাম- নিসর্গ আর আপন বলয়ের মানুষ নিয়ে নিজের স্বাধীন, স্বত:স্ফূর্ত, আত্মজাগরণ ঘটিয়েছেন তিনি কবিতায়। আল মাহমুদ তাই লেখেন :

১. “বলো তোমার জন্যই কি আমরা হাতে নেইনি আগুন?

নদীগুলোকে ফণা ধরতে শেখায়নি কি তোমার জন্য-

শুধু তোমারই জন্য গাছে গাছে ফুলের বদলে

ফুটিয়ে ছিলাম ফুলকি।

আম গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফলেছিল গ্রেনেড ফল।

আর সবুজের ভেতর থেকে ফুৎকার দিয়ে

বেরিয়ে এলো গম্বুজের ধোঁয়া।

আহ

আমি এখন আর চোখ মেলতে পারছি না।”

[নিশিডাক, লোক-লোকান্তর]

 

২. “তোমার গোসল আমি দেখিনি একদা তিতাসে?

মনে পড়ে? শ্বশ্মানঘাটের সেই সিঁড়ি ছুঁয়ে নেমে যায় জল

ডোবায় সে পাদ পাদ্ম। সাফরী পুঁটির ঝাঁক আসে

আঙ্গুল ঠুকরে খেতে। নদী যেন নদীতে পাগল।”

নদীর ভিতরে যেন উষ্ণ এক নদী স্নান করে

তিতাসের গন্ধ জলে প্রক্ষালনে নেমেছে তিতাসেই।

নিজের শাপলা লয়ে খেলা করে নদীর ভিতরে

ঠাট্টা বা বিদ্রুপ নেই, নেই শেননচক্ষু, নেই চরণের বাঁলি।’

[নদীর ভিতরে নদী, নদীর ভিতরে নদী]

 

৩. কবিতা বোঝে না এই বাংলার কেউ আর

দেশের অগণ্য চাষী, চাপরাসি

ডাক্তার, উকিল, মোক্তার

পুলিশ দারোগা ছাত্র অধ্যাপক সব

কাজের ব্যাপারে নীরব।

স্মাগলার আলোচক সম্পাদক তরুণীর দল,

কবিতা বোঝে না কোনো সঙ

অভিনেত্রী নটীনারী নাটের মহল

কার মানে কতটুকু রং?

ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা

সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে কবিতা বোঝে না।’

[ ‘অবুঝের সমীকরণ, ‘লোক-লোকান্তর’ ]

 

৪. ‘কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম,

গন্ধভরা ঘাস

ম্লান মুখে বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর

গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর

কবিতাতো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার’।

[ ‘কবিতা এমন’, ‘সোনালী কাবিন’ ]

নগরের অধিবাসীদের জীবনে গ্লানি, ক্লেদ, ক্লান্তি, হতাশা, সমাজ ও সভ্যতার ফাঁপা, রুক্ষ ও নির্দয় আচরণ আল মাহমুদের কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। কবির কেবলই মনে হয়‘সূর্য কেবল দহন করে’। নগরের মৃত বৃক্ষ ছায়াহীন। সেখানে সকল অদর্ম মিথ্যা বলে প্রতিভাত। সত্য কেবল ‘ Help of broken images’.

নগর শান্তি ও সম্ভাবনার খবর জানাতে ব্যর্থ। আর তাই অস্বস্তি নিয়ে আল মাহমুদের নগর জীবনে অভ্যস্ত ক্লান্তিকর জীবন-যাপন। নগরের অন্তঃসারশূন্যতার কারণে এলিয়টের কাছে সন্ধ্যা কোনো রোমান্টিক আবহ নিয়ে আসেনি। সন্ধ্যা এলিয়টের কাছে বিবর্ণ, মৃতপ্রায় রোগীর মতো মনে হয়েছে।  Alfred Prufrock বলেছেন- Like a patient etherised upon a battle.

এলিয়ট ছিলেন শূন্যগর্ভ ফাঁপা সভ্যতায় রূপ দেখা মানুষ। আল মাহমুদ-ও এর ব্যতিক্রম নন। রুক্ষ, বিবর্ণ, ফাঁপা, সম্ভাবনাহীন সভ্যতাকে দেখে এলিয়টের মনে হয়েছিলো- ‘এ কেমন সভ্যতা? এ কেমন নগর? এ কেমন জনপদ? যেখানে ফসল ফলে না? পানির শব্দ নেই- ঝরনার শব্দ নেই’:

Here is no water but only rock

rock and no watter and the sandy road.

অন্যদিকে আল মাহমুদ উচাচরণ করেন:

‘ফলন্ত কবির হাত বুলোতে বুলোতে তোর পিঠে

বোদলেয়ার রেখেছেন যে কয়টি অদ্ভুত চরণ

ফের বেঁচে তা-ই, বন্দীর হৃদয়ে রন্ধ্রে, ইটে,

যদিও কেশম তোর শুভ্র নয়, রাত্রির বরণ-।

যেন শত বৎসরের অতি দূরে ব্যবধান ঠেলে

এসেছে নগরী এক গাত্রবর্ণ। পাল্টে নিয়ে তার

ঘাঘরা, জুতোর ফিতে, আর গূঢ় দড়ি খুলে ফেলে

কালো পেড়ে নীলাম্বরী মেলে দেয় দারুণ বাহার।’

আমরা এর আগে এলিয়টের প্রসঙ্গ এনেছি। আবারও প্রসঙ্গক্রমে এলিয়ট এসে দাঁড়ান সামনে। এলিয়টের কাছে

পৃথিবীকে মনে হয়েছ বন্ধ্যা, মরুভূমিতুল্য। আবার মনে হয়েছে ফনিমনসায় পূর্ণ পাঙ্গুরে ভূমি :

There is the dead land

There is the cactus land

Here the stone images

are raised.

সমর সেন নগর জীবনের প্রতিশ্রুতিহীন এবং শ্বাসরোধকারী পরিবেশ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেয়ে উচ্চারণ করেছেন:

ভস্ম অপমান শয্যা ছাড়

‘হে মহানগরী।

রুদ্ধশ্বাস রাত্রির শেষে

জ্বলন্ত আগুনের কাছে আমাদের প্রার্থনা,

সমান জীবনের অস্পষ্ট চকিত স্বপ্ন

আর কত লাল শাড়ি আর নরমবুক, আর টেরিকাটা মসৃণ মানুষ

আর হাওয়ায় কত গোল্ডফ্রেকের গন্ধ,

হে মহানগরী।’

শ্রম শোষণ, শ্রেণি বৈষম্য এবং তার অনিবার্য পরিণাম উঠে এসেছে আল মাহমুদের কবিতায়। নিপীড়িত, নির্যাতিত নিষ্পসিত, দলিত, মাহিত, বঞ্চিত মানুষেরা শ্রমশোষণকারী, বিত্তবান তথাকথিত ‘এলিট’ শ্রেণির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের অভিজাত জীবন-যাপন এবং স্বার্থ দেখেছে। কিন্তু শ্রেণি বৈষম্যের নিরসন এবং লুটেরাদের রুখে দাঁড়ানোর এবং তাদের প্রতি বিদ্রোহের দাবানল জ্বালাতে যে বাহুবল, অঙ্গীকার, প্রত্যয় দরকার-সেটি তাদের নেই। এই বৈষম্যদুষ্ট সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ার জন্যে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা তাদের নেই। আল মাহমুদ এইসব নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত বঞ্চিত মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি লেখেন:

১. ‘মাৎস্যন্যায়ে সায় নেই, আমি কৌম সমাজের লোক

সরল সাম্যের ধ্বনি তুমি নারী তোমার নগরে,

কোনো সামন্তের নামে কোনোদিন রচিনি শোলোক

শোষকের খাড়া ঝোলে এই নগ্ন মস্তকের পরে।’

 

২. ‘শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়াছে হাত

হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,

এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত

তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকমা।

আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,

পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,

এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী কারো উচ্চারণ

যেন না ঢুকতে পারে লোক ধর্মে আর ভেদাভেদ।’

গ্লানিময়, ব্যর্থতাক্লিষ্ট নগরজীবনের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে আল মাহমুদের কবিতায়। সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণু রুগ্নতাও তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। ফাঁপা, অন্তঃসারশূন্য চরিত্র চিত্রণ করতে গিয়ে আল মাহমুদ যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

আধুনিক মানুষের নৈঃসঙ্গবোধ ও বিচ্ছিন্নতাবোধ আল মাহমুদের কবিতার অন্যতম প্রাণশক্তি। নগরে বসবাসরত এই কবি নিজেকে মনে করেন ‘আউট সাইডার’। শারীরিকভাবে তিনি নগরে বসবাস করলেও মানসিকভাবে তিনি গ্রামীণ নিসর্গে ও প্রকৃতিতে নিজেকে নিবেদন করেছেন।

যন্ত্রসভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিমানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈঃসঙ্গ্য, অসহায়ত্ব আল মাহমুদের কবিতার বিষয়-আশয় হিসেবে এসেছে। মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতাবোধ, হতাশা বোধের পরিণতি হিসেবে নৈঃসঙ্গ্য তাঁর কবিতায় সহজেই প্রবেশাধিকার পেয়েছে। যন্ত্রসভ্যতার কবলে পড়ে মানুষ নিজেই যেন শ্রমযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ফলে শ্রমজ উৎপাদন ও প্রত্যক্ষ করে বৈরী শক্তির রূপ। বিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গে তাই আমাদের মনে পড়ে যায় সমাজবিজ্ঞান অভিধানে সংজ্ঞায়িত বিচ্ছিন্নতার সংজ্ঞা :

Alienation is a social psychological  condition of the individual which involves his estrangement from creation aspects of his social existence.

[D.G.  ritched (Ed), A Dictionary Sociology , London 1968. P.4 ]

নগর ও নগরে অভ্যস্ত জীবন-যাপন আল মাহমুদের কাছে সামগ্রিক বৈনাশিকতার প্রতীক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ইউরোপে পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার সমূহ বিপর্যয় মানুষকে নিক্ষেপ করেছিলো নিঃসীম অন্ধকারে, চরম অনিশ্চয়তার অতল গহ্বরে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে মানুষ হয়েছিলো উন্মুল অস্তিত্ব যাপনে অভ্যস্ত। এই বৈনাশিকতার প্রেক্ষাপটে দেশে দেশে যাপিত হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য নগরজীবন। নৈঃসঙ্গের গরল আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় তুলে আনেন এভাবে:

পাখিরা ঘুমিয়েছে ঘুমায় চরাচর

তোমার নাম তবে ভুলেরই খতিয়ান?

ভ্রমের মাধুরীতে কবির কবজায়

কে তুমি খোঁজো আজো নিজেরই সন্ধান।

নগর শান্তি ও সম্ভাবনার খবর জানাতে ব্যর্থ। আর তাই অস্বস্তি নিয়ে আল মাহমুদের নগরে ক্লান্তিকর জীবন-যাপন। নগরের অন্তঃসারশূণ্যতার কারণে গ্রাম, নিসর্গ আর আপন বলয়ের মানুষ নিয়ে নিজের স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত, আত্মজাগরণ ঘটিয়েছেন তিনি কবিতায়। আল মাহমুদ তাই উচ্চারণ করেন:

আমার ঘরে একজন জাতীয় নেতার ছবি রয়েছে

আমি সেদিকে তাকাতে ভয় পাই

একবার সেদিকে চোখ পড়লেই ছবিটা

পঁচিশে মার্চের রাত্রি হয়ে যায়।

পারতপক্ষে আমি নিজের ছবির দিকেও তাকাই না

বিশ্রী রেখাবহুল পোট্রেট।

একবার চোখ পড়লেই ছবিটা

কাঁপতে কাঁপতে এক বড়ো-সড়ো গ্রাম হয়ে যায়

এঁদো ডোবা। কচুরিপানার ওপর বেগুনি ফুল লেবুপাতার

ভেতর দিয়ে ধাবমান বাতাস। গোবরের গন্ধ। কোকিল।

পাটখেতে দমবন্ধ গরমের মধ্যে মুল্লাবাড়ির সবচেয়ে

রূপসী মেয়েটিকে চুমু খাওয়া।

মার্কসবাদে অদীক্ষিত আল মাহমুদের কবিতায় সাম্যবাদ কল্পবর্গীয় পয়গম্বরিতা নিয়ে হাজির হয়নি। সমাজ জীবনের ছায়া ও রোদ নিয়েই হাজির হয়েছে। কবিতার বিষয়বস্তু, আঙ্গিকে, মনোভঙ্গিতে লোকায়ত জীবনের সূত্র ধরেই সাম্যবাদী চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। আধুনিক কবিতায় নগর ও গ্রামের সহাবস্থান কখনো কখনো অনিবার্য হয়ে ওঠে। আল মাহমুদের কবিতায় সেটিই হয়েছে। নাগরিক বিষণ্নতা থেকে মুক্তি ও নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণেই এমনটি হয়। এ প্রসঙ্গে অশ্রুকুমার সিকদারের মন্তব্য:

“আধুনিক কবি, বিশেষ করে এই দশকের কবিমাত্রই উদ্বাস্তু, প্রবাসী-সভ্যতার পঙ্গু বিভ্রান্ত এই অবস্থায় দীর্ঘ প্রবাস, নগরের নিমর্মতায় এই দীর্ঘ উদ্বাস্তু জীবন কবিদের কোনো কোনো সময়ে প্রার্থিত নীড়ে আশ্রয় নেবার দুরাশায় উন্মুখ করে তোলে, এমনকি যে কোনো নীড়ে। নগরের ধূলি ধূম্রজালে কেউ মাঠের শস্যের স্বপ্ন দেখে, নিষিদ্ধ আকাশের স্বপ্ন দেখে, কেউ কেউ যায় গ্রামের মেলায়, মুক্তি-লিপ্ত, কারো কাছে ঈর্ষণীয় মনে হয় ভ্রাম্যমাণ বেদিয়ার জীবন, কারো কবিতার একমাত্র বিষয় হয়ে ওঠে অচিহ্নিত নস্টালজিয়া, ঘরে ফেরার আকাঙ্ক্ষার তীব্রতায়, ফিরতে না পারার আত্মকরুণায় প্রবাসী নিজেকেই ব্যর্থ মনে করে।”

আল মাহমুদ তাই লেখেন:

১. ইটের নিচে চাপাপড়া আমার কক্ষের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম, সুটকেস, পোশাক-আশাক, বইপত্র সবকিছু ঢাকা পড়ে আছে। কোন কিছুই উদ্ধারের আশা নেই। আমি শুধু বিছানার ওপর থেকে সেই মহাগ্রন্থের কাছে নেমে এলাম। যখন দুই হাত বাড়িয়ে তা বুকের কাছে তুলে আসতে যাবো, খোলা পৃষ্ঠায় একটা আয়াতের ওপর নজর পড়লো।

২. আমি বলি, সেতো লালমাটিয়া মহিলা কলেজে এখন মেয়েদের বাংলা পড়ায় আর পরীক্ষার খাতা দেখে নিজের নৈঃসঙ্গ্য যাপন করছে। বিশ্বাস করো, লোকটা একটুও না হেসে তার প্রশ্নের পাশে শুধু তোমার নামের নির্ভুল বানান লিখে নিয়ে চলে গেলেন।

এলিয়ট লেখেন:

“In the room women come and go Talking of Michelangelo.”

আল মাহমুদের কবিতা হয়ে উঠেছে বৃহত্তর সমাজ মানসের কণ্ঠস্বর। গ্রামীণ প্রকৃতি-নিসর্গ, পরিবেশ-প্রতিবেশ, মানুষ ও মানুষের যাপিত জীবন যখনই আল মাহমুদের কবিতায় এসেছে, তখনই তাঁর স্বদেশ নিষ্ঠা ও শেকড়ের টান সহজেই অনুভব করা যায়। আল মাহমুদ এ বিষয়ে দ্বিধা ও সংশয়মুক্ত যে, আমাদের সামগ্রিক জীবনাচরণ লোক ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কবিতায় লোকজ উপাদানের ব্যবহার আধুনিক মনস্কতারই পরিচায়ক। ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনা, নস্টালজিয়া, প্রত্ন-স্মৃতির পরিচর্য। আধুনিক শিল্পিধ্যানেরই পরিচায়ক। আল মাহমুদের কবিতায় স্বদেশ-চেতনা ও সমকাল উৎসারিত হৃদয়-অনুভবকে আলিঙ্গন করে নাগরিক অনুষঙ্গ এসেছে।

কাব্যযাত্রার শুরুতে আত্মসংকট ও নেতিচেতনায় নিমজ্জিত হলেও আল মাহমুদ সাত তাড়াতাড়ি স্বাদেশিকতাবোধে উজ্জীবিত হয়ে উঠেন। এই স্বাদেশিকতাবোধই নৈরাশ্যের পীড়ন থেকে মুক্তি দেয় তাঁকে। আলিঙ্গন করেন তিনি স্বদেশ, লোকজীবন, গ্রামীণ-নিসর্গ-পৃথিবী, তিতাস ও তিতাস বাহিত জন-জীবনের উত্তাপ এবং প্রকৃতি ও নিসর্গের বৈভব। কবি লেখেন:

১. মেঘনার শান্ত মেয়ে তিতাসে

মেঘের মতো পাল উড়িয়ে কী যে ভাসে।

[তিতাস একটি নদীর নাম, লোক-লোকান্তর]

 

২. সারাদিন তীর ভাঙ্গে, পাক খায়, ঘোলা স্রোত টানে

যৌবনের প্রতীকের অসংখ্য নৌকার পানে

গতির প্রবাহ হানে। মাটির কলস জল ভরে

ঘরে ফিরে ছলিমের বউ তার ভিজা দুটি পায়।

 

৩. তোমার গোসল আমি দেখেনি কি একদা তিতাসে?

মনে পড়ে? শ্মশান ঘাটের সেই সিঁড়ি ছুঁয়ে নেমে যায় জল

ডোবা সে পাদপদ্ম/ সাফরী পুঁটির ঝাঁকে আসে আঙুল ঠুকরে খেতে

নদী যেন নদীতে পাল।

[নদীর ভেতর নদী, নদীর ভেতর নদী]

প্রেম ও রোমান্সের ক্ষেত্রে আল মাহমুদ লাজুক নম্র নন। এ ক্ষেত্রে তিনি কখনো কখনো উন্মত্ত, খোলামেলা। আল মাহমুদের কবিতায় প্রেমিকতার বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। পৌরুষ, যৌনতা, স্বপ্নময়তার অনুষঙ্গ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে কবিকে। স্ব-সন্দীপনে, স্বন্দিত আবেগে প্রেমের কবিতা রচনা করেন আল মাহমুদ। প্রেমিকাকে প্রলুব্ধ করেন তিনি প্রেমিক সত্তার উষ্ণতায়, প্রেমিকাকে দিশেহারা করে তোলেন তিনি প্রেম নামক স্বেচ্ছাচারের প্রসারিত করতলে। কবি লেখেন:

১. নগ্ন হও, শিশু যেন দ্যাখেনি পোশাক

ভালোবাসা, তামসিক কামফলা শিখে এলে

যেন এক অক্ষয় যুবতী

তখন কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল

যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর নিম্ন নাভিমূল।

 

২. বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল

পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না,

তুমি যদি খাও তবে আমাকে দিও সেই ফল

জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা পরাজিত নই

নারী, পরাজিত হয় না কবিরা,

দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।

[সোনালী কাবিন, সোনালী কাবিন]

 

৩. ঘুমের ছল কামের জল

এখনো নাভিমূলে,

মোছেনি তবু আবার এলো

আগের শয্যায়,

[শূন্য হাওয়ায়, লোক-লোকান্তর]

 

৪. নারী হলো একটা ভাঁজ করা জামদানি

আমি আড় চোখে দেখি এর গোপন চুমকির কাজ

 

৬. আমার চুম্বনরাশি ক্রমাগত তোমার গতরে

ঢেলে দিবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল।

এ ব্যতিক্রম বানু এ মস্তকে নামুক লানৎ

ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।

 

প্রকৃতি ও নারীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে আল মাহমুদ লেখেন:

কত নারী কত ঘাটে কত বাটে মাঠে তেপান্তরে

আমাকে তাদের বশীকরণের ফুৎকারে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে।

আমি কেঁপেছি ঠিকই

কিন্তু এক দৈব নির্দেশের মতো আমার ভেতরের কোকিল

আমাকে ডাকতে পার করে নিয়েছে তেপান্তরের মাঠ।

[আত্মার কুহু ধনি, লোক-লোকান্তর]

আল মাহমুদ স্বাদেশিক ঐতিহ্যের কবি, প্রকৃতি-নিসর্গের কবি, সামাজিক সাম্যের কবি এবং প্রেম ও যৌনতার কবি। এক্ষেত্রে তিনি অযুত সাফল্য লাভ করেন।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
‘জবাবদিহি নিশ্চিতে ডিএনসিসির সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে’
‘জবাবদিহি নিশ্চিতে ডিএনসিসির সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে’
ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলো বিশেষ ফিউশন খাবার উপস্থাপনা
ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলো বিশেষ ফিউশন খাবার উপস্থাপনা
পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের স্ক্র্যাপ শেডে আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি
পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের স্ক্র্যাপ শেডে আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি
সর্বাধিক পঠিত
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
রিজার্ভ আরও বাড়লো
রিজার্ভ আরও বাড়লো
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’