X
সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২

কবি আসাদ চৌধুরীকে রাজাকার বানানোর অপচেষ্টা

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:১৭আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:৩৯

কবি আসাদ চৌধুরী শেষ জীবনে পুরো পরিবার নিয়ে কানাডায় অভিবাসী হয়েছিলেন। ফলে বাসস্থান টরন্টোতে গড়ে উঠেছিল তার আরেক সামাজিক পরিবার। মাত্র কয়েক বছরেই তিনি বাঙালি কমিউনিটিতে হয়ে উঠেছিলেন মধ্যমণি। স্থানীয় প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয় এবং সমাদৃত হয়ে উঠেছিলেন। তার মৃত্যুতে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিরা গভীর শোকের সাগরে নিমজ্জিত হয়েছে। তার শেষকৃত্যে বিপুল মানুষের ঢল নেমেছিল।

ব্লাড ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে তিনি ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তার জানাজা-দাফন সম্পন্ন হয় পরদিন ৬ অক্টোবর। মাত্র এই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নানামুখী একতরফা বিতর্ক তোলা হয় সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুকে: এক. কেন তার লাশ দেশে পাঠানো হলো না! দুই. কেন ড্যানফোর্থের শহিদ মিনারে নেওয়া হলো না? তিনি. তিনি তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না! চার. কেন তিনি দেশ-বিদেশের নানান সংকটে পাশে ছিলেন না ইত্যাদি।

২০২২ সালের ১০ নভেম্বর আসাদ ভাই এবং তার মেয়ের জামাইর সাথে ওয়াশিংটন বইমেলা থেকে ফেরার পথে টরন্টোতে কিপলিং-টু-কেনেডির ট্রেনে হঠাৎ দেখা। তখন অভিযোগের শেষোক্ত বিষয়টি নিয়ে আমার সাথে বিস্তারিত আলোচনার পর আংশিক মীমাংসিত হয়। তা নিয়ে অন্য দিন লিখব। আজ একটি বিষয় পরিষ্কার করব; তা হচ্ছে—তার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া নিয়ে অযথা বিতর্কিত প্রশ্ন উপস্থাপন।

আসাদ ভাই অসুস্থ হওয়ার পর দৈনিক ইত্তেফাকে কমপক্ষে দশটি নিউজ ছাপা হয়েছে। তার মৃত্যুর খবরে আমি ‘বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা’ এ শিরোনামে লিখেছি। সে নিউজ ঢাকার অনেক মিডিয়া পুনঃপ্রকাশ করেছে। আমাদের টরন্টোর সিবিএন ২৪-ও তা প্রকাশ করেছে। সেখানে জনৈক জিয়া ইসলাম দুই পর্বে প্রতিবাদ করে লিখেছেন—‘আসাদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন—এই খবরটা তো বোমা ফাটানোর মতো…আবেগের বশবর্তী হয়ে অতিরঞ্জিত উপাধি দেওয়া থেকে বিরত থাকাই উত্তম।’

শুধু তাই নয়, জনৈক জিয়া আসাদ ভাইয়ের গ্রামের প্রতিবেশী দাবি করে আরো আপত্তিকর কথা লিখেছেন: ‘আসাদ চৌধুরীর পরিবার নাগর চৌধুরীরা না কি উলানিয়া বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে! পাকিস্তানিদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা এবং গ্রামের নারীদের পাচার করেছে!’

আমি এই আপত্তিকর বক্তব্য দেখিনি। সিবিএন ২৪-এর সম্পাদক স্নেহভাজন মাহবুব ওসমানী আমাকে ইনবক্সে স্ক্রিনশট পাঠিয়েছেন। আমি কাজে থাকায় তা দেখা হয়নি। পরে ওসমানী আবার লিখেছেন—‘আমিতো ইত্তেফাক থেকে আপনার নিউজ থেকে কপি করেছিলাম।’

তখন আমি ওসমানী এবং নাদিম ইকবালের সাথে এই বিষয়গুলো নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করি। আসাদ চৌধুরী এবং তার ভাই আবদুল গাফফার চৌধুরীর অবদান সম্পর্কে কে না জানে? স্বাধীনতার ইতিহাসে তাদের নাম তো স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। যা ঐতিহাসিক সত্য।

এইসব অজ্ঞ এবং অশিক্ষিতদের জবাব দেওয়াটাও সময়ের অপচয়। তবু একজন সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক এবং মুক্তিযুদ্ধের গবেষক হিসেবে এই মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করে একের পর এক তথ্য ওসমানীর কাছে উপস্থাপন করি।

প্রথমত, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক (বর্তমানে সাবেক) কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন—“বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত তার (আসাদ চৌধুরীর) ‘কোন অলকার ফুল’, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ কিংবা ‘সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু’র মতো বইগুলো এদেশের কয়েক প্রজন্মের শিশুকিশোরদের মাঝে ছড়িয়েছে ইতিহাসের সত্যসন্ধ সহজ পাঠের দ্যুতি। মহান মুক্তিযুদ্ধে আসাদ চৌধুরীর অনন্য ভূমিকা কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয়৷ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সঙ্গে তার সংযোগ একাত্তরের সংস্কৃতি যোদ্ধা হিসেবে তার ভূমিকাকে মহিমান্বিত করেছে।” (তারিখ: ৬ অক্টোবর ২০২৩)

দ্বিতীয়ত, কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন—“বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের জনপ্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী শুধু কবিই ছিলেন না—তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধাও। ১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দসৈনিক ছিলেন তিনি। তার জ্ঞাতিভাই—একুশের অমর গানের রচয়িতা, তখনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী তখন কলকাতা থেকে ‘জয় বাংলা’ নামে যে সাপ্তাহিক পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন, কবি আসাদ চৌধুরী ঐ পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।” (তারিখ: ৭ অক্টোবর ২০২৩)

তৃতীয়ত, তিনি মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একাধিক ঐতিহাসিক কবিতা লিখেছেন। রচনা করেছেন: ‘কোন অলকার ফুল’, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু’র মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।

চতুর্থত, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন, তা উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ ‘মুক্তিযোদ্ধা-কবি’ হিসেবে শোক বার্তা দেয়।

পঞ্চমত, আসাদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তার খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা হয়। সর্বোপরি বিধি মোতাবেক দূতাবাসের মাধ্যমে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করে শেষ বিদায় জানানো হয়।

অতপর সেই জিয়া দ্রুত সুর পাল্টিয়ে জবাব দেন—“ধন্যবাদ ভাই, আমার ভুল ভাঙানোর জন্য। চাচা (আসাদ চৌধুরী) যে স্বাধীন বাংলা বেতারে সম্পৃক্ত ছিলেন, এই তথ্যটি অজানা ছিল। এমন সোনার মানুষ হাজার বছরে একজন জন্মায়।”

মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও শ্রেণি বিন্যাস আছে। যা রাষ্ট্রীয়ভাবেই অনুমোদিত। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা, শব্দ সৈনিক, বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি। আমাদের লেখকদের মধ্যে কবি রফিক আজাদ, হারুন হাবীব, মাহবুব সাদিক, আবিদ আনোয়ার, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ইখতিয়ার চৌধুরী, হালিম আজাদ, সিরু বাঙালি, ইসহাক খান-সহ আরো অনেকেই ছিলেন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধা লেখক-সাংবাদিক হারুন হাবীব ১৯৭১ সালে স্বচক্ষে কলকাতায় আসাদ চৌধুরীকে একাধিকবার দেখেছেন। হারুন ভাই বলেন, “আমি যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিনিধি ছিলাম। তখন কাজে কলকাতায় গিয়ে আসাদ ভাইকে ‘জয় বাংলা’-এর অফিসে দেখেছি।”

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ গার্মেন্টসকর্মীর মৃত্যু
গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ গার্মেন্টসকর্মীর মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে দুই স্কুলছাত্রসহ প্রাণ গেলো ৪ জনের
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে দুই স্কুলছাত্রসহ প্রাণ গেলো ৪ জনের
ভিটামিন-সমৃদ্ধ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা খোলা ড্রাম
ভিটামিন-সমৃদ্ধ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা খোলা ড্রাম
কিশোরগঞ্জে হাওরে বজ্রাঘাতে ৩ জনের মৃত্যু
কিশোরগঞ্জে হাওরে বজ্রাঘাতে ৩ জনের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা, কেড়ে নেওয়া হলো মাইক
মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা, কেড়ে নেওয়া হলো মাইক
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
রিজার্ভ আরও বাড়লো
রিজার্ভ আরও বাড়লো