অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজের প্রকাশক ও সম্পাদক, ক্রীড়া সংগঠক ও লেখক কাজী শাহেদ আহমেদ ২৮ আগস্ট রাতে পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তের দিকে।
কাছে থেকে আমার দেখা উচ্চবিত্তদের মধ্যে সম্ভবত কাজী শাহেদ আহমেদই একইসঙ্গে সবচেয়ে বেশি রসবোধ, ব্যক্তিত্ববোধ, সাহিত্য-সংস্কৃতিবোধ ও হৃদয়বোধসম্পন্ন মানুষ। বাইরে থেকে দেখতে অসম্ভব রাগী, কিন্তু মনের দিক থেকে অত্যন্ত কোমল ছিলেন। ২০০৪ সালের মে মাসে শামীম ভাইয়ের (তৎকালীন সাহিত্য সম্পাদক কবি শামীম রেজা) মাধ্যমে দৈনিক আজকের কাগজে সাব-এডিটর হিসেবে সাংবাদিকের জীবন শুরু করি, নিউজ রুমে। কাজ শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই একদিন সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ দেখলাম আমাদের ফ্লোরে লোকজনের মধ্যে কেমন একটা তৎপরতা শুরু হয়ে গেল! সবাই দ্রুত গিয়ে যার যার আসনে বসে যাচ্ছেন, টেবিল-চেয়ার ও কাগজপত্র গুছিয়ে রাখছেন, জামাকাপড় ঠিকঠাক করে নিচ্ছেন, কেউ কেউ মাথার চুলও আছড়াচ্ছেন। কর্মীদের গলার আওয়াজে যে অফিস সব সময় গমগম করে, সেই অফিস মুহূর্তেই অনেকটা নীরব হয়ে গেল—এর কারণ কী, জানতে চাইলাম পুরোনো সহকর্মীদের কাছে। একজন বললেন, ‘স্যার আসতেছেন।’ দ্বিধায় পড়ে গেলাম। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম, এখানে আবার স্যার কে? এই অফিসে তো সিনিয়র-জুনিয়র সবাই সবাইকে 'ভাই' বলে ডাকে। সহকর্মীকে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘স্যার কে?’ তিনি বললেন, ‘একটু পরই দেখতে পারবেন, ওয়েট।’
৫-৭ মিনিট পরই দেখলাম একজন ভদ্রলোক গুটি গুটি পায়ে আমাদের ফ্লোরে ঢুকলেন। তাঁর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, কাঁধে শালজাতীয় কিছু একটা, ডান হাতে একটা বাঁকা হাতলের লাঠি। ফ্লোরে ঢুকেই প্রথমে নিউজ এডিটর খালেদ ফারুকী ও অ্যাসোসিয়েট এডিটর আবু বকর চৌধুরীর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। খালেদ ভাই ও বকর ভাই দুজন পাশাপাশি বসতেন। তাঁরা দুজনই দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন, কুশল বিনিময় করলেন। আজ দিনের বড় ঘটনা কী কী—ভদ্রলোক জানতে চাইলেন। দুজনই বিনীতভাবে সংক্ষিপ্ত করে জানালেন। এরপর হেঁটে হেঁটে প্রতিটি সেকশন ঘুরে দেখলেন, দু-একজনের সঙ্গে দুই-একটা কথাও বললেন। তখন ফ্লোরজুড়ে সুনশান নীরবতা। আমাদের টেবিলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে প্রথমবারের মতো কাছ থেকে দেখলাম এবং চিনতে পারলাম, তিনিই কাজী শাহেদ আহমেদ। চিনতে পারলাম কারণ তাঁর ছবি আমি আগেই দেখেছিলাম। ৪-৫ মিনিটের মধ্যেই ফ্লোর ঘুরে দেখে বেরিয়ে গেলেন। তিনি যেতে না যেতেই পুরো ফ্লোর আবারও গমগম করে উঠল সাংবাদিকদের গলার আওয়াজে।
সেদিনই জানলাম, কাজী শাহেদ আহমেদকে সবাই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। তিনি পত্রিকাটির মালিক, প্রকাশক ও সম্পাদক। তাঁর বড় ছেলে কাজী নাবিল আহমেদ (বর্তমানে সংসদ সদস্য) তখন পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক; তাঁকে সবাই ‘ভাই’ বলে ডাকে। অসম্ভব ভদ্র, মার্জিত, রুচিশীল মানুষ হিসেবে সেই অফিসে পেয়েছিলাম নাবিল ভাইকেও।
ধীরে ধীরে কাজের সূত্রে কাজী শাহেদ আহমেদের কাছে যাওয়া, কাছ থেকে দেখা, কথা ও গল্প শোনা হয়েছে বহু বহুদিন। গল্প করতে পছন্দ করতেন, সেই গল্পে হাস্যরসও থাকত, আবার গূঢ় গম্ভীর তত্ত্ববোধও থাকতো।
সম্ভবত ২০০৬ সালের দিকে, হঠাৎ আজকের কাগজসহ জেমকন গ্রুপের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঢাকায় কর্মরত সবাইকে জানানো হলো, আগামীকাল সকাল ১১টায় সবাইকে ধানমন্ডির চৌধুরী কমিউনিটি সেন্টারে উপস্থিত থাকতে বলেছেন স্যার। কী বিষয়? কেউ জানে না। সবাই পড়েছে টেনশনে। শামীম ভাইসহ সিনিয়র দুই একজন সাংবাদিক নাবিল ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলেন, স্যার কাল কেন ডেকেছেন, আপনি জানেন কিছু? জবাবে নাবিল ভাই বললেন, ‘আব্বা তো আম্মা ও আমাদের তিন ভাইকেও কাল ১১টায় উপস্থিত থাকতে বলেছেন। কিন্তু কেন ডেকেছেন, আমাদেরও বলেননি। আমরাও টেনশনে আছি।’
টেনশন নিয়েই রাত কাটল সবার। সকাল ১১টার আগে থেকেই লোকজন জড়ো হতে থাকল কমিউনিটি সেন্টারে। ঘড়িতে ১১টা বাজতেই সহধর্মিণী আমিনা আহমেদ, তিন ছেলে কাজী নাবিল আহমেদ, কাজী আনিস আহমেদ ও কাজী ইনাম আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে উপস্থিত হন কাজী শাহেদ আহমেদ। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়, কী বলবেন স্যার আজ। স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে মঞ্চে উঠলেন তিনি। গম্ভীরমুখে মাইকের সামনে বসে কয়েক মিনিট চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন সামনের দর্শক সারির দিকে। সবাই নীরব। হঠাৎ কথা শুরু করলেন তিনি। বললেন, ‘কী সবাই জানতে চান তো কেন ডেকেছি? তাহলে শুনুন—
আমি এক সময় কষ্টে দিন কাটিয়েছি। সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছি। চাকরি ছেড়ে ব্যবসার উদ্যোগ নিই। তখনো খুব বেশি টাকা ছিল না। স্বামী-স্ত্রী দুজনের চেষ্টায় সবার সহযোগিতায় তিলে তিলে প্রতিষ্ঠান গড়েছি, ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি। আসলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো আপনারা গড়েছেন, আপনারা শ্রমঘাম, মেধা দিয়ে, আন্তরিকতা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রেখেছেন, এগিয়ে নিচ্ছেন। আপনাদের আন্তরিকতা না থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়াতে পারত না। আপনারা আমার পরিবারের অংশ। পরিবার মানে তো সবচেয়ে আপনজন। কিন্তু চিন্তা করে দেখলাম, পরিবারের অংশ হলেও আপনাদের সঙ্গে আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সবাই একসঙ্গে কখনো বসে আলাপ আলোচনা করা হয়নি, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করা হয়নি। তাই আজ আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে এখানে দুপুরের খাবার খাব। গল্প করব। তারপর ধীরে ধীরে যে যার কাজে চলে যাব।’
কাজী শাহেদ আহমেদ তাঁর এই বক্তব্য দেওয়ার পর উপস্থিত সবাই যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। সেদিন অনেক গল্প করলেন তিনি। মাইকে কথা বলেন তাঁর সহধর্মিণী ও ছেলেরাও। ভরপুর খাওয়াদাওয়া হলো। আনন্দ-আড্ডা হলো। সেই অনুষ্ঠানের আবহে একবারও মনেই হয়নি, সামনে স্বয়ং মালিক ও তাঁর পরিবার বসে আছেন। এই কৃতিত্ব সম্পূর্ণ কাজী শাহেদ আহমদের। অনেক মিডিয়া অফিসে যেসব নোংরা পলিটিক্সের চর্চা হয়, তার ছিটেফোঁটাও আজকের কাগজে ছিল না। পুরো অফিসটা সত্যিই একটা পরিবারের মতোই ছিল। আর এটা সম্ভব হয়েছিল কাজী শাহেদ আহমেদের কারণেই।
আরেকটি ঘটনা খুব মনে পড়ে। ২০০৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হঠাৎ করেই আজকের কাগজ বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় মালিকপক্ষ। যেন আকাশ ভেঙে পড়ে কর্মীদের মাথার ওপর। ওইদিনই খবর আসে, তিনদিনের মধ্যে সবার অগ্রিম তিন মাসের বেতনসহ পাওনা টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। হয়ও তাই। তবে শামীম ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের ছয়জনের চাকরি বলবৎ থাকে আজকের কাগজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কাগজ প্রকাশনে। এছাড়া বকর ভাই, সমরদাসহ কয়েকজনের চাকরিও বলবৎ থাকে আজকের কাগজ আবার প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হবে ভেবে৷ ধানমণ্ডি ১৫ নম্বর এলাকায় মীনা বাজারের বিল্ডিংয়ের তিন ও চার তলায় ছিল আজকের কাগজ অফিস; সম্ভবত বর্তমানে ইউল্যাবের ক্লাস হয় ওই বিল্ডিংয়ে।
আমরা সেই বিল্ডিংয়ে তখন সকাল ১১টা-১২টার দিকে ঢুকি, সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে আসি। সারাদিন কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্রাউজ করি। কবিতা লিখি। সাহিত্য, দর্শনের গোষ্ঠী উদ্ধার করি। আড্ডা মারি। গান গাই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মন ভালো নেই। ওই বিল্ডিংয়ে ঢুকলেই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কেননা, দিন রাত যেখানে সাংবাদিকদের পদচারণায় গমগম করত, সেখানে এখন সুনসান নীরবতা।
পত্রিকা বন্ধ ঘোষণার সপ্তাহখানেক পরে, একদিন বিকেলের দিকে ভবনের চারতলা থেকে তিনতলায় নামছি সিগারেট খাওয়ার রুমে যাব বলে। এমন সময় লিফটের কাছে দেখলাম কাজী শাহেদ আহমেদকে। তিনি নিচে নামবেন, সঙ্গে তাঁর সহকারী হিসেবে সম্ভবত বাদলদা ছিলেন। সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন স্যার? কখন এলেন?’ তিনি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধু বললেন, ‘দেখতে এলাম, কফিন!’ এটুকু বলেই লিফটে নিচে নেমে গেলেন। সেদিন তাঁর চোখেমুখে যে বিষাদ দেখেছিলাম, তা আর কোনোদিন দেখিনি।
এরপর যখন ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরের সড়কে জেমকন গ্রুপের অফিসে আমাদের শিফট করা হলো, তখন কাজী শাহেদ আহমেদ, কাজী নাবিল আহমেদ, কাজী আনিস আহমেদ ও কাজী ইনাম আহমেদের রুমের পাশে একটা রুমে শামীম ভাইসহ আমরা পাঁচজন বসতাম। সেসময় জেমকন পুরস্কার, কাগজ প্রকাশনের বই প্রকাশ ও বইমেলায় অংশ নেওয়া, আবাহনী ক্রীড়াচক্রের বিভিন্ন প্রকাশনাসহ বেশ কিছু প্রকাশনা ও অনুষ্ঠান আয়োজনের কাজ করতাম আমরা। তখন খুব কাছ থেকে তাঁদের দেখেছি। কথা বলেছি। তখন আরো গভীরভাবে কাজী শাহেদ আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক ও ইনটেলেকচুয়াল হাইট সম্পর্কে অনুধাবন করেছি।
কাজী শাহেদ আহমেদ ব্যক্তিজীবনে কতটুকু ভালো বা কতটুকু খারাপ ছিলেন, তা সময়ই বিচার করবে। তবে এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশের নতুন ধরনের, সাহসী সাংবাদিকতা ও সাংবাদিক তৈরির আঁতুড়ঘর হিসেবে আজকের কাগজের যে ভূমিকা, তার জন্য হলেও কাজী শাহেদ আহমেদ বেঁচে থাকবেন, ইতিহাসের পাতায়।