২৪ ফেব্রুয়ারি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মীর কাসেমের মামলার শুনানির শেষ দিন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থার কাজ নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
তিনি বলেন, ‘তাদের (প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থা) পেছনে সরকার যথেষ্ট অর্থ খরচ করছে। অথচ তারা সঠিকভাবে মামলা তদন্ত ও পরিচালনা করছেন বলে মনে হয় না।’ প্রসিকিউশনের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
গত ৮ মার্চ শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয় জনকে হত্যার দায়ে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত আকারে আপিল মামলাটির চূড়ান্ত রায় দেন আপিল বিভাগ।
সোমবার মীর কাসেমের ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখা আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আদালতের পর্যবেক্ষণে প্রসিকিউশনের জন্য বড় অংশ রাখা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, যেহেতু মীর কাসেম বেশ ক্ষমতাশালী ছিলেন সেহেতু এ মামলায় প্রসিকিউশনের সতর্ক থাকা জরুরি ছিল। একাধিক প্রসিকিউটর মামলা পরিচালনার জন্য ভালো হলেও দুই প্রসিকিউটরের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে মীর কাসেম আলীর লবিস্ট নিয়োগের বিষয়ে শুনানির সময় একটি কাগজ দাখিল করেছিলাম। আদালত বলেছেন, বিচার বন্ধে ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন কি করেননি সেটা প্রমাণসাপেক্ষ ব্যাপার। তবে লবিস্টদের দেওয়া রশিদ বিবেচনায় নিয়ে বলেছেন, মীর কাসেম আলী খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং বিচারকে নষ্ট করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রসিকিউটরদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আদালত।’
রায়ে উল্লেখ আছে, আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, সরকার একজন প্রধান প্রসিকিউটর নিয়োগ দিয়েছেন যার অধীনে বেশ কয়েকজন প্রসিকিউটর কাজ করেন। তাদের মধ্যে দুইজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ও দক্ষ প্রসিকিউটর আছেন যাদের ‘রহস্যজনকভাবে’ এ মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়নি। মীর কাসেম ভীষণ ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছিলেন উল্লেখ করে বলা হয়, যে কিনা কিলিং স্কোয়াড নামে খ্যাত ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন। ফলে এই মামলার ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের অনেক সতর্ক থাকা উচিত ছিল।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নারী ও কিশোরীর সম্ভ্রমের বিপরীতে আমরা এ স্বাধীনতা লাভ করেছি। স্বাধীনতা অর্জনে আর কোনও জাতি এতো ত্যাগ স্বীকার করেনি। ভিকটিম ও দেশের মানুষের আবেগ অনুভূতি জড়িত থাকায় এ বিচারকে হালকাভাবে নেওয়ার কিছু নেই। তারা ন্যয়বিচার চাই।
বিচার পরিচালনার কথা তুলে ধরে আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণে বলেন, ট্রাইব্যুনালে ১১ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। সুলতান মাহমুদ ও জিয়াদ আল মালুম সাক্ষীদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করতে সহায়তা করেন।
মামলাটি দুজন প্রসিকিউটর পরিচালনা করলেও আদালত জবানবন্দি গ্রহণের দিন উল্লেখ করে আপিল বিভাগ বলেন, একইসঙ্গে দুজন প্রসিকিউটর উপস্থিত ছিলেন না। যখন একজন প্রসিকিউটর মামলা পরিচালনা করেন তিনি অভিযোগ প্রমাণে কিভাবে কাজ করবেন তার পরিকল্পনা করেন। এটা অনেকটা বিরতি দৃশ্যসহ থিয়েটারের পারফরমেন্সের মতোই যেখানে অবশ্যই প্রথম দৃশ্যের সঙ্গে শেষ দৃশ্যের মিল থাকতে হবে। যদি দুজন পরিচালক পৃথকভাবে দৃটি দৃশ্য পরিচালনা করে তাহলে ঘটনার পরম্পরায় খাদ থাকবে।
তবে পর্যবেক্ষণে এও বলা আছে, দুজন প্রসিকিউটর মিলে মামলা করতে কোনও সমস্যা নেই। বরং সেটা অনেকক্ষেত্রে ভালো। কিন্তু যখন একাধিক প্রসিকিউটর যুক্ত হবেন তখন তাদের মধ্যে আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে একজন প্রসিকিউটর কিছু সাক্ষী নিয়েছেন আরেকজন কিছু সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়েছেন ফলে ধারাবাহিকতা নস্ট হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আদালত বলেছেন চার্জ নম্বর ৩২ এর ক্ষেত্রে প্রসিকিউশন ২০ ২১ ২২ সাক্ষী গ্রহণ করেছেন। এরমধ্যে ২০ নম্বর নিয়েছেন সুলতান মাহমুদ, বাকি দুটো নিয়েছেন জিয়াদ আল মালুম। তিন নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, প্রসিকিউশন ১, ২, ৩, ১৪, ১৬ নম্বর সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়েছেন যার মধ্যে সুলতান মাহমুদ নিয়েছে ১ থেকে ৩ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য এবং জিয়াদ আল মালুম নিয়েছেন ১৪ ও ১৬। তারা যৌথভাবে মামলা পরিচালনা করলেও একইসঙ্গে ট্রাইব্যুনালে কাজটি না করার সমালোচনাও করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৮ মার্চ শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয় জনকে হত্যার দায়ে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত আকারে আপিল মামলাটির চূড়ান্ত রায় দেন আপিল বিভাগ।
২০১৪ সালের ০২ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানবতাবিরোধী অপরাধের হোতা মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ৩০ নভেম্বর খালাস চেয়ে মীর কাসেম আলী আপিল করেন।
/ইউআই/এজে