ধর্মীয় গাম্ভীর্য আর প্রকৃতির নির্মলতা একসঙ্গে মিশেছে সীতাকুণ্ডের পাহাড় সারির সবচেয়ে উচুঁ চূড়া চন্দ্রনাথ মন্দিরে। এটি মূলত একটি বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মিথ ও ধর্মীয় ঐতিহ্য। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের দিকে শিব চতুর্দশীতে এখানকার মেলায় যোগ দেন দেশ-বিদেশের লাখো পর্যটক। এছাড়া সারাবছরই লেগে থাকে পুণ্যার্থীদের ভিড়।
চন্দ্রনাথ ধামকে ঘিরে প্রচলিত আছে সনাতন ধর্মীয় বেশকিছু ঘটনা। সনাতন ধর্মীয় মতে, সত্যযুগে সীতা দেহ ত্যাগ করলে মহাদেব তার মৃতদেহ নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করে। এ সময় বিষ্ণু সীতার মৃতদেহ ছেদন করে। তার দেহখণ্ড বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সেই জায়গাগুলো হয়ে ওঠে শক্তিপীঠ, সনাতন ধর্মীয় মানুষের তীর্থস্থান। চন্দ্রনাথ মন্দির তেমনই একটি জায়গা।
মন্দিরটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তবে ১২০০ ফুট উঁচু এই চূড়ায় পৌঁছানো বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। পাহাড়ের গোড়া অবধি পৌঁছাতেই শরীর ঘেমে ওঠে। চূড়ায় যাওয়ার দুটি পথ। হাতের ডান দিকের সিঁড়ি উঠে গেছে একেবারে চূড়া অবধি। বাঁ-দিকের পথ বেছে নিলে ডিঙোতে হবে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা। তবে ওঠার জন্য বামের পথটি তুলনামূলক সহজ। কারণ ডানে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ওঠা স্বাভাবিকভাবে কঠিন। আমরা বামের রাস্তা ধরে এগোলাম।
কিছুদূর উঠতেই চোখে পড়ে সীতাকুণ্ড রেঞ্জের আদিগন্ত সবুজের মেলা। ঢেউ খেলানো ফসলের মাঠ, রেললাইন, সমুদ্র। উচ্চতা ডিঙানোর ক্লান্তি ভর করলেও ওপরে নীল আকাশ আর দূর-দিগন্তে সাগর থেকে উঠ আসা লোনা হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দেয়। কিন্তু বিরুপাক্ষ পর্যন্ত পথটা একটু বেশিই খাড়া। এ কারণে একটু থেমে থেমে চলতে হলো। তবে একবার বিরুপাক্ষ পর্যন্ত উঠে গেলেই হলো, মনে হবে এ যেন সাক্ষাৎ স্বর্গ! ঘাসে বসার পর কানে এলো ঘণ্টার ধ্বনি। ক্লান্ত শরীর চাঙা করে আবারও খাড়া পাহাড়ি রাস্তা ধরে উঠছি।
আরেক জায়গায় খানিকটা বসতে হলো। প্রায় সাড়ে ১১০০ ফুট উচ্চতায় তখন। এরপর আর না থেমে আরও পঞ্চাশেক ফুট জোর কদমে ডিঙিয়ে সরাসরি চন্দ্রনাথ মন্দিরে পৌঁছালাম আমরা। চারপাশে অতুলনীয় ঐশ্বর্য। দূরে সাগরের লোনা ঘ্রাণ আর অনেক নিচে পাহাড়ি লালমাটির পথ। এসবের সঙ্গে পূজার ঘণ্টাধ্বনি। যদিও ১২০০ ফুট উচ্চতা পর্বতারোহণের হিসেবে ঈর্ষণীয় কিছু নয়। তবুও অদ্ভুত ভালোলাগার ঘোর সুর বাজতে থাকলো মনে।
জানা প্রয়োজন
ঢাকার কমলাপুর, সায়েদাবাদ, কল্যাণপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে চট্টগ্রামের গাড়ি ছাড়ে। সেগুলোতে চড়ে সীতাকুণ্ড যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে সব বাসই সীতাকুণ্ডে থামে। ট্রেনে চড়ে যেতে চাইলে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী মেইল ট্রেনে উঠতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ট্রেনগুলোর মধ্যে শুধু এই ট্রেন সীতাকুণ্ড স্টেশনে থামে।
সীতাকুণ্ড বাজার থেকে চন্দ্রনাথ ধামের প্রবেশদ্বারে যাওয়ার সিএনজি ভাড়া ১০০ টাকা। মূল মন্দিরে যেতে হাইকিং করতে হবে। মন্দির থেকে নামার সময় সিঁড়ির পথ ধরা ভালো। পাশ দিয়ে ইকো পার্কের দিকে চলে যাওয়া রাস্তায় গেলে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার আশঙ্কা বেশি। রাতের আগেই চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়া ভালো।
ছবি: জুয়েল থিওটোনিয়াস ও শামীমা মিতু