সেন্ট্রাল হাসপাতালে ‘গাফেলতি ও ভুল চিকিৎসায়’ নবজাতকসহ প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল এবং গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন। লিখিত অভিযোগপত্রে ডা. সংযুক্তা সাহার নিবন্ধন বাতিল এবং একইসঙ্গে স্ত্রী ও নবজাতকের মৃত্যুতে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের দাবিও জানান তিনি।
রবিবার (২৫ জুন) বিএমডিসির প্রেসিডেন্ট এবং রেজিস্ট্রার বরাবর জমা দেওয়া এক আবেদনে এস দাবির কথা জানান ইয়াকুব আলী সুমন।
সুমন তার অভিযোগে উল্লেখ করেন, আমার অনুমতি ছাড়াই অজ্ঞান অবস্থায় আঁখিকে ওটিতে নিয়ে সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা বের করা হয়। পরবর্তী সময়ে আমি ডা. মাকসুদা আক্তার মিলি, ডা. এহসানকেও ওটিতে দেখতে পাই। আমি ডা. সংযুক্তা সাহাকে খোঁজাখুঁজি করলে তারা সকালে আমাকে জানান—ডা. সংযুক্তা সাহা নেই। ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা স্বীকার করেন যে ডা. সংযুক্তা সাহার নির্দেশে তিনি এ কাজ করেছেন। এরপর রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে বলে। কিন্তু আমি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের সহযোগিতায় আমার স্ত্রীকে ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে সিসিইউতে ভর্তি করাই।
আঁখির স্বামী আরও বলেন, ‘ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে জানানো হয়—আমার সন্তান মারা গেছে এবং তাকে মর্গে রেখেছে। এরপর গত ১৮ জুন দুপুরে আমার স্ত্রী মাহবুবা রহমানও ইন্তেকাল করেন। পরে ১৯ জুন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পোস্ট মর্টেম শেষে রাত ১০টায় কুমিল্লার লাকসামে নিয়ে আমার স্ত্রী ও সন্তানকে দাফন করা হয়।’
পারিবারিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আমার স্ত্রী মাহবুবা রহমানের বাবা, ভাইবোন কেউই নেই। বিধবা মা তার একমাত্র সন্তান মাহবুবা রহমানকে খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছেন। মাহবুবা রহমান চাকরি করে মায়ের কষ্ট লাঘব করবেন, এমন প্রত্যাশা ছিল। মাহবুবা রহমান রাজধানীর সরকারি ইডেন মহিলা কলেজে গণিত বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত ছিল। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আঁখির মাও এখন মৃতপ্রায়।’
আঁখি স্বামী আরও বলেন, ‘আমি গত তিন বছর ধরে আমার স্ত্রী মাহবুবা রহমানকে নিয়ে খুব সুখে শান্তিতে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করছিলাম। আমাদের সন্তানকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা, অনেক আয়োজন, অনেক কেনাকাটা হয়েছিল। কিন্তু সেন্ট্রাল হাসপাতালের ভুল চিকিৎসায় নিমিষেই যেন সবকিছু শেষ হয়ে গেলো। আমি এখন বেঁচে থাকার সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছি।’
অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমার স্ত্রী ও নবজাতককে হত্যা করা হয়েছে। এজন্য আমি দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করছি। একইসঙ্গে সেন্ট্রাল হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন এবং ডা. সংযুক্তা সাহার রেজিস্ট্রেশন বাতিলের দাবি করছি।’
আঁখির স্বামীর অভিযোগের বিষয়ে বিএমডিসি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেন জানান, প্রয়াত মাহবুবা রহমান আঁখির স্বামী একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এটা অফিসিয়াল প্রক্রিয়ায় নথিভুক্ত করা হবে। পরবর্তী সময়ে এই লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
উল্লেখ্য, গত তিন মাস ধরে সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। এ সময় তার শারীরিক অবস্থা ‘স্বাভাবিক’ ছিল বলেও চিকিৎসক জানিয়েছিলেন। নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমেই সন্তান প্রসব সম্ভব বলে আশ্বস্তও করেছিলেন ডা. সংযুক্তা সাহা। প্রসব ব্যথা ওঠায় গত ৯ জুন দিবাগত রাত ১২টা ৫০ মিনিটে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তার অধীনে মাহবুবাকে ভর্তি করানো হয়। ওই সময় ডা. সংযুক্তা সাহা দেশেই ছিলেন না, অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর স্বজনদের জানায়, সংযুক্তা সাহা আছেন এবং ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) কাজ করছেন। এরপর অন্য চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা ব্যর্থ হলে অস্ত্রোপচার করে বাচ্চা বের করা হয়। কিন্তু পরদিন মারা যায় শিশুটি। আর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ জুন দুপুরে মারা যান মাহবুবুর রহমান আঁখি।
আরও পড়ুন:
সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের জামিন নামঞ্জুর
আঁখির হাসপাতালে ভর্তির ‘তথ্য জানতেন’ ডা. সংযুক্তা সাহা
সরেজমিন সেন্ট্রাল হাসপাতাল: সেবার নামে অরাজকতা চলে যেখানে
কী ঘটেছিল অপারেশন থিয়েটারে, যেসব প্রশ্নের জবাব মিলছে না
সেন্ট্রাল হাসপাতালকে দুষছেন ডা. সংযুক্তা
আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি
সেন্ট্রাল হাসপাতালে সব ধরনের অপারেশন বন্ধের নির্দেশ
সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুই চিকিৎসক কারাগারে
নবজাতকের মৃত্যু: সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের দায় স্বীকার
ডা. সংযুক্তা সাহার কারণেই আজ এই অবস্থা: সেন্ট্রাল হাসপাতাল