বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে মানুষের দৈনিক গড় ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। বিবিএসের দাবি, ২০১০ সালে মাথাপিছু গড়ে ২৩১৮.৩ ক্যালরি গ্রহণ করতো মানুষ। এর ৬ বছর পর ২০১৬ সালে গড় ক্যালরিগ্রহণের পরিমাণ কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২২১০.৪। তবে ২০২২ সালে মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৯৩.০-তে। দেখা যাচ্ছে, একযুগের ব্যবধানে মানুষের ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ সামান্যই বেড়েছে। বিবিসের জরিপের এই তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই জরিপ থেকে সিদ্ধান্তে আসাটা এক ধরনের ‘স্ট্যাটিসটিক্যাল ধাঁধা’। বিবিএস কোন প্রেক্ষাপটে, কী অবস্থায়, কোন পদ্ধতিতে এই জরিপ করেছে সেটা দেখার বিষয়। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষ এখন আগের চেয়ে খাওয়ার বিষয়ে সচেতন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের মানুষ বর্তমানে দৈনিক গড়ে ২৩৯৩ ক্যালরি খাবার গ্রহণ করে। চাল, ডাল, গম, শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও ফলমূল থেকেই সাধারণত এই ক্যালরি আসে। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালে দেশের মানুষ গড়ে দৈনিক ২২১০ ক্যালরি খাবার গ্রহণ করতো। ‘খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২’ -এর প্রাথমিক ফলাফলে এ তথ্য উঠে এসেছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ১৪ হাজার ৪০০ খানার তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে জরিপের এ ফল প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কোন পদ্ধতি মেনে জরিপটি হচ্ছে সেটা বিবেচনায় নেয়া খুব জরুরি। অসমানুপাতিক বিষয়ে গড় করলে দুর্বলের ওপর চাপ বাড়ে।
খাদ্যগ্রহণ মাথাপিছু কত গ্রাম
২০২২ সালে গত ১২ বছরের তুলনায় খাদ্য হিসেবে চালের গ্রহণ কমেছে। জরিপ বলছে, গ্রামে ২০১০ সালে মাথাপিছু ৪৪১ দশমিক ৬ গ্রাম চালের গ্রহীতা দেখা গেলেও ২০২২ সালে সেটা ৩৪৯ দশমিক ১ গ্রাম হয়েছে। আর শহরের ক্ষেত্রে ২০১০ সালে পরিমাণটা ছিল মাথাপিছু ৩৪৪ দশমিক ২ গ্রাম, যা ২০২২ সালে এসে ২৮৪.৭ গ্রাম হয়েছে। অপরদিকে মাছ ও ডিমের ক্ষেত্রে মাথাপিছু গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১০ সালে গ্রামে মাছের মাথাপিছু গ্রহণ ছিল ৫৯ দশমিক ৬ গ্রাম, যা ২০২২ সালে হয়েছে ৬৭ দশমিক৭ গ্রাম। আর শহরে ১০ বছর আগে ছিল মাথাপিছু ৮৫ দশমিক ১ গ্রাম, আর ২০২২ সালে সেটা হয়েছে ৬৮ দশমিক ২ গ্রাম। ডিমের ক্ষেত্রেও মানুষের মাঝে আগের চেয়ে পরিমাণে বেশি গ্রহণ করার প্রবণতা দেখা গেছে।
শহর-গ্রামে দুধ ও ফল গ্রহণ বেড়েছে
২০১০ সালে গ্রামে মাথাপিছু দুধ ও দুধ জাতীয় পণ্যের গ্রহণ ৩১ দশমিক ৮ গ্রাম হলেও ২০২২ সালে তা ৩২ দশমিক ১ গ্রাম হয়েছে। শহরে এর পরিমাণ ২০১০ সালে ৩৯ দশমিক ২ গ্রাম হলেও জরিপ বছরে ৩৮ দশমিক ৫ গ্রাম হয়েছে। ফল গ্রহণে গ্রামে ২০১০ সালে মাথাপিছু ৪২ দশমিক ৬ গ্রাম হলেও ২০২২ সালে ৯০ দশমিক ৯ গ্রাম হয়েছে। আর শহরে ২০১০ সালে মাথাপিছু ফল খেতো ৫০ দশমিক ৪ গ্রাম, বর্তমানে তা মাথাপিছু ১০৫ দশমিক ৩ গ্রামে দাঁড়িয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ডা. লেলিন চৌধুরী এটাকে ‘স্ট্যাটিসটিক্যাল ধাঁধা’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘১০০ জনের মধ্যে ১৫ জনের হয়তো সক্ষমতা বেড়েছে। বাকিদের কমেছে। গড় হিসাব করলে সেটা কমেছে যাদের, তাদের ভাগেও পড়বে। খাওয়ার ব্যাপারেও তাই। জাতীয় ডাটার দিকে যদি তাকাই, শিশুদের অপুষ্টিজনিত খর্বতার হার ৩০-৩১ শতাংশ ছিল। এটা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। সংক্রামক-অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির প্রবণতা রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে অপুষ্টির সংযোগ আছে। অপুষ্টি মানে খাদ্যের অভাব না, সুষম খাদ্যের অভাব। গড় হিসাব দিয়ে মানুষের খাদ্যগ্রহণ পরিস্থিতি বুঝা সম্ভব না।’
দ্রব্যমূল্য বাড়লে ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণে চাপ আসবে, সেটা পুরোপুরি ঠিক না, উল্লেখ করে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট নাজনীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরিবারগুলো যখন চাপ অনুভব করে, তখন তাদের জীবন-যাপনে সবশেষে খাদ্য কমানোতে হাত দেয়। এর আগে বাজে খরচ বা তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জীবন থেকে বাদ দেয়। দ্রব্যমূল্য বাড়লেও ক্যালরি গ্রহণ বাড়তে পারে। বহু মানুষ যদি অপুষ্টিতে ভুগতো, তাহলে খালি চোখে দেখতে পাওয়া যেতো এবং গ্রামের মানুষ শহরে চলে আসতো।’
জরিপের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এখানে জরিপে অংশগ্রহণকারী ধনী-গরিব মিলিতভাবে আছে। ফলে এটা সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে হয়তো যথাযথ হবে না। কেননা, গড়ের ভাগ দুর্বলের ওপর পড়ে। যারা অতিরিক্ত গরিব ক্যাটাগরিতে আছেন, সেই নাগরিকরা মাছ-মাংস নিয়মিত খেতে না পারলেও নিশ্চয়ই খাদ্যতালিকায় বিকল্প কিছু ঢুকিয়ে ঘাটতি পূরণ করে।’