ষাটোর্ধ্ব রাহিমা বেগম ডিমেনশিয়ায় (ভুলে যাওয়া রোগ) ভুগছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তার চলাফেরাতেও অনেক কষ্ট। মেয়ে আতিয়া দেখভাল করেন তার। আতিয়া চাকরিজীবী। মায়ের দেখভালকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে চাকরি নিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাকে। অফিসের জরুরি কাজ পড়লে কাউকে ম্যানেজ করে বাড়িতে রেখে যান। তবে এভাবে কতদিন– প্রশ্ন আতিয়ার। একজন কেয়ার গিভার থাকলে কিছুটা সহায়ক হতো বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মস্তিষ্কের রোগ আলঝেইমার্স ও ডিমেনশিয়া রোগের মধ্যে বয়সভেদে পার্থক্য রয়েছে। ডিমেনশিয়ার কারণে যেকোনও বয়সেই স্মৃতি হারিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে আলঝেইমার্স রোগের সঙ্গে বয়স বাড়ার একটি সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত ৬৫ বছর ও এরপর থেকেই এই রোগের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। কিন্তু ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার্স উভয় রোগের ক্ষেত্রেই স্মৃতি হারিয়ে যায় বলে প্রায়শই এই দুইয়ের এক সঙ্গে আলোচনা করা হয়।
সেপ্টেম্বর মাসকে ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার্স সচেতনতা মাস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও ২১ সেপ্টেম্বর আলঝেইমার্স দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য– ‘আলঝেইমারকে জানুন, ডিমেনশিয়াকে জানুন’।
বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বছরের বয়সীদের মধ্যে প্রতি ১২ জনে একজন ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। গতবছর এক গবেষণায় এই তথ্য জানানো হয়। বাংলাদেশে সাতটি বিভাগে ২০১৯ সালে আইসিডিডিআর,বি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স শহর ও গ্রাম মিলিয়ে দুই হাজার ৭৯৬ জন ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে এই জরিপ চালায়। গবেষণার তথ্য বলছে, প্রতি ১২ জন ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে একজন ডিমেনশিয়াতে আক্রান্ত। এক্ষেত্রে ৮ শতাংশ হারে ডিমেনশিয়ার প্রভাব পাওয়া যায়। নারীদের মধ্যে সমবয়সী পুরুষদের তুলনায় ডিমেনশিয়ার প্রকোপ শতকরা দুই দশমিক ৫ গুণ বেশি।
সমীক্ষায় অনুমান করা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট ডিমেনশিয়া রোগের সংখ্যা ছিল ১.১ মিলিয়ন। তাদের মধ্যে ০.২৮ মিলিয়ন পুরুষ এবং ০.৮৮ মিলিয়ন নারী। একইসঙ্গে গবেষণা দেখা গেছে, ২০২৫ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়াবে ১.৩৭ মিলিয়নে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণেরও বেশি হবে (২.৪ মিলিয়ন)। যদি উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
চিকিৎসকদের মতে, ডিমেনশিয়া একটা ‘ভুলে যাওয়া’ রোগ। সাধারণত ষাটোর্ধ্ব মানুষের এটা বেশি হয়। গড় আয়ু যত বাড়বে, ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যা তত বেশি হবে। মানুষের মস্তিষ্ক শত কোটির বেশি নিউরনে গঠিত। এরা ইলেকট্রিক তারের মতো কাজ করে। এসব নিউরনের মধ্যে ঠিকমতো যোগাযোগ না হওয়ার জন্য মানুষ স্মৃতিভ্রষ্ট হতে পারে। এর জন্য মানুষ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগী প্রায় কোনও কাজই নিজেরা সঠিকভাবে করতে পারে না। এমনকি বাড়ি বা বাসার সামনে ছেড়ে দিলেও বাসাটি চিনে বাড়িতে আসতে পারে না। প্রিয় মানুষদের চিনতে পারে না, সবকিছু মুহূর্তেই ভুলে যায়। এ জন্য তারা সম্পূর্ণ অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাই তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকার জন্য একজন মানুষের প্রয়োজন পড়ে। এজন্য তার একজন কেয়ার গিভারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের দেশে পর্যাপ্ত কেয়ার গিভার নেই।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. নাজমুল হক মুন্না বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি তাদের একজন কেয়ার গিভার প্রয়োজন আছে। ডিমেনশিয়ার রোগীদের খাওয়া-দাওয়া, বাথরুমে যাওয়া সবকিছুই বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে তাদের পার্সোনাল কেয়ার প্রয়োজন হয়। রোগীদের জন্য ঘরকে একটু সহজ করতে হয় যাতে তারা পড়ে গিয়ে ব্যথা না পান। এছাড়া তাদের ফিজিওথেরাপি বা ব্যায়ামের প্রয়োজন অনেক। একটা মানুষ তার দেখভালের জন্য সবসময় প্রয়োজন হয়।
তিনি আরও বলেন, বয়স ৭০ এর ওপর হয়ে গেলে প্রতি ১০০ জনে ১৩ জনের এই রোগ দেখা দেয়।
বাংলাদেশ আলঝেইমারস সোসাইটির মহাসচিব আজিজুল হক বলেন, এই রোগীদের দেখভাল খুব ভালো করে করতে হয়। পরিবারের মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর আমাদের দেশে প্রশিক্ষিত কেয়ার গিভার নেই। পরিবারের মানুষের এই বিষয়ে ধারণা একটু কম। পরিবারের সদস্যরা মনে করেন— হয়তো রোগটি ভালো হবে, এজন্য যত্নের দিকে না যেয়ে চিকিৎসার দিকে বেশি ঝুঁকে। আমাদের দেশে এই মুহূর্তে একটি ডিমেনশিয়া অ্যাক্ট খুব জরুরি। অ্যাক্ট হলে এই মানুষগুলো অবহেলিত কিংবা অমানবিক জীবনযাপন করতো না। সেজন্য আমাদের দেশে আইন করা উচিত এবং অসংখ্য প্রশিক্ষিত কেয়ার গিভার তৈরি করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, সামনের দিনগুলোতে একটা বড় ক্রাইসিস দেখা দিতে পারে। যেহেতু কেয়ার গিভার নেই, এই রোগীদের কিন্তু ২৪ ঘণ্টা দেখভাল করতে হয়। তাতে পরিবারের সদস্যদের সময় দিতে গিয়ে আয়ের ওপর প্রভাব পড়ছে। কারও চাকরি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, কারও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব পড়ছে। অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাবা-মায়ের সেবা করছে। তার চেয়ে বড় সমস্যা এই রোগী দেখতে গিয়ে সুস্থ মানুষও অনেক সময় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটা জাতীয় নীতিমালা অবশ্যই তৈরি করা উচিত।