দেশে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে খরচ হয় তিনলাখ টাকা। আর দেশের বাইরে ভারতে কিংবা চীনে গেলে এই খরচ পড়ে ৪০ লাখ টাকা। চিকিৎসকরা বলছেন, শুধু প্রচারণার অভাবে এবং সচেতনতা না থাকায় মানুষ এখনও বিদেশে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাচ্ছেন।
বাংলাদেশ রেনাল ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বের ৮৫ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, এদের মধ্যে ২৪ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আর দেশে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট প্যাকেজ অনুযায়ী খরচ পড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ১১ জন শিশুসহ ৫৪০ জনের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মজনু মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত চার বছর ধরে কিডনি রোগে ভুগছি। আমার দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে। প্রতি সপ্তাহে আমি তিনদিন ডায়ালায়সিস করাই। আমার মা আমাকে কিডনি দিতে চান, কিন্তু কিডনি দেওয়ার জন্য অস্ত্রোপচার করতে যে খরচ হবে, তা আমাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। সে কারণে আমার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট এখন থমকে আছে।’
কেবল মজনু মিয়াই নন, দেশে কিডনি রোগে আক্রান্ত বহু রোগী অর্থের অভাবে ট্রান্সপ্লান্ট করাতে পারছেন না। অন্যদিকে, যাদের অর্থ আছে তারা বিদেশে গিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করাচ্ছেন। এই অবস্থার পরিবর্তনে চিকিৎসকরা বলছেন,দেশেই কম খরচে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা যাচ্ছে। এর জন্য প্রচারণাসহ সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার।
দেশে ট্রান্সপ্লান্ট কম হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডায়ালায়সিস করালে কিডনির শুধু বেসিক কিছু ফাংশন কাজ করে। সব ফাংশন করাতে ট্রান্সপ্লান্টের বিকল্প নেই। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য বড় অন্তরায় হলো— আমাদের দেশে এ বিষয়ে অতো প্রচারণা নেই। দ্বিতীয়ত ডোনার নেই। এছাড়া, আমাদের অর্থ নেই এবং সাপোর্ট নেই। দেশে নেতিবাচক প্রচারগুলো বেশি হয়। পজিটিভ অ্যাটিচ্যুড কোনও লেভেলে নেই, যার কারণে যেকোনও একটা প্রবলেমে এটা (ট্রান্সপ্লান্ট) থেমে যেতে পারে। এটা সাকসেসফুল করতে সবার হেল্প লাগবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে ট্রান্সপ্লান্ট করাতে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। অথচ বিদেশে গেলে এই খরচ ৪০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে দেশ থেকে বিদেশে ডোনার নিয়ে যান। এতে করে ডোনার, রোগী এবং অর্থ সবই দেশ থেকে যাচ্ছে। আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ।
ট্রান্সপ্লান্ট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হেলথ রাইটস মুভমেন্টস এর প্রেসিডেন্ট ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নৈতিকতার দিক থেকে কিডনি বেচাকেনা কোনও দেশই অ্যাকসেপ্ট করে না। উন্নত বিশ্বেও এটা ভলান্টারিভাবে হয়। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে গেলে প্রথম দরকার কিডনির সহজ লভ্যতা। যখন কিডনি সহজে পাওয়া যায় না, তখন ট্রান্সপ্লান্ট করা কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু বিদেশে কোনও ডোনার নিয়ে গেলে তারা অতবেশি নৈতিকতা দেখে না। তারা ডোনার পেলে ও অর্থ পেলে ট্রান্সপ্লান্ট করে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ক্ষেত্রে আইনের কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগে শুধু ছিল ফাস্ট ডিগ্রি আত্মীয়রা কিডনি দিতে পারবে। এখন সেকেন্ড ডিগ্রির আত্মীয়রাও দিতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশে যেটা দেখা যাচ্ছে— সম্প্রতি আমরা এই রকম একটা সমস্যা নিয়ে মিটিং করলাম। পুলিশ রিপোর্ট, ন্যাশনাল আইডি এগুলো দিয়ে আত্মীয় প্রমাণ করে কিডনি দেওয়া যায়। আবার ডিএনএ টেস্ট করে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট কেউ করতে চায় কিনা। কিন্তু এটি করতে গেলেও খরচ বেশি পড়ে। সুতরাং এই কমপ্লেক্সগুলোর কারণে এদেশে অত সহজে ট্রান্সপ্লান্ট হয় না। ডোনারের পর্যাপ্ততা না এলে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা যাবে না।’
ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘যিনি কিডনি দিতে আসছেন, তিনি সজ্ঞানে কিডনি দিতে আসছেন কিনা, সেটা মনিটরিং করা দরকার। কিন্তু এই মনিটরিং আমাদের নেই। সুতরাং আমরা মনে করি, কিডনি ডোনারের এটা ইচ্ছাকৃত হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত কোনও চক্র যেন এটা বেচাকেনা না করে, সেটা সরকার প্রটেকশন দিলে আমার মনে হয় ট্রান্সপ্লান্টেশনটা দেশে বাড়বে।’
আরও পড়ুন:
ডায়ালাইসিসের সুবিধা পান মাত্র এক-চতুর্থাংশ কিডনি রোগী
ডোনারের অভাবে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয় না নারীদের