ভোরের আলো ফুটতেই ১০ বছর বয়সী ইউসুফ আল-নাজ্জার ছুটেছেন গাজা সিটির একটি কমিউনিটি কিচেনের দিকে, হাতে একটি পুরোনো হাঁড়ি। সেখানে পৌঁছে দেখে, তার আগেই শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছেন। ফিসফিসিয়ে ইউসুফ বলছিলো, মানুষ ঠেলাঠেলি করে, যাতে পালা মিস না হয়। ছোট ছোট শিশুরা মাটিতে পড়ে যায়।
প্রতিদিন হাজার হাজার গাজাবাসী, বিশেষ করে শিশু-কিশোররা, পরিবারে খাবার জোগাড়ের আশায় এসব কমিউনিটি কিচেনের দিকে ছুটছে। ২ মার্চ ইসরায়েল সব ধরনের সহায়তা প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে গাজায় মানবিক সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
খাদ্য সরবরাহ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) শুক্রবার জানিয়েছে, তারা তাদের শেষ খাদ্য মজুত বিতরণ করেছে।
যুদ্ধে বাবাকে হারানোর পর পরিবারের দায়িত্ব ইউসুফের কাঁধে পড়েছে। এখন তার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন—মা ও বোনের সঙ্গে একসঙ্গে বসে শান্তিতে খাওয়া।
সে বলে, অনেক সময় হুড়োহুড়িতে হাঁড়ি পড়ে যায়, খাবার মাটিতে ছিটকে পড়ে। তখন খালি হাতে বাড়ি ফিরি... এই যন্ত্রণা ক্ষুধার চেয়েও বেশি কষ্টের।
গাজা সিটির একটি কমিউনিটি কিচেনে এএফপির ফুটেজে দেখা গেছে, অগণিত শিশু থালা-পাত্র সামনে বাড়িয়ে খাবার সংগ্রহের জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে। এক তরুণকে একটি ধাতব হাঁড়ি দিয়ে এক শিশুকে আঘাত করতেও দেখা গেছে।
গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত মোহাম্মদ আবু সানাদ বলেন, আমি পাঁচ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, শুধু বাচ্চাদের জন্য এক প্লেট ভাত পাওয়ার আশায়। কোনও আয় রোজগার নেই। কমিউনিটি কিচেন থেকে খাবার পেলেই খাই, না পেলে না খেয়ে থাকতে হয়।
ডব্লিউএফপি সতর্ক করেছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এসব কিচেনের খাবার মজুত শেষ হয়ে যাবে।
গাজার নুসাইরাত এলাকার আয়েদা আবু রায়ালার (৪২) জন্য খাবারের প্রয়োজন এখন সবচেয়ে বেশি। রায়ালা নামের একজন বলেন, আটা নেই, রুটি নেই, বাচ্চাদের খাওয়ানোর কোনও উপায় নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে পুড়ে কিংবা ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় খাবার শেষ হয়ে যায়, আমার পালা আসার আগেই।
একটি বিমান হামলায় রায়ালার বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। এখন তারা পাতলা নাইলনের ত্রিপলের নিচে বাস করছেন। একদিন তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন তার পালা আসে, তখন আর খাবার অবশিষ্ট ছিল না।
তিনি বলেন, খালি হাতে বাড়ি ফিরি। বাচ্চারা কাঁদে... তখন মনে হয়েছিল, তাদের এভাবে কাঁদতে দেখার চেয়ে মৃত্যু ভালো।
বৈত লাহিয়ায় একটি দাতব্য কিচেন চালান ৫২ বছর বয়সী স্বেচ্ছাসেবক ফাতেন আল-মাধুন। ১৩ জন স্বেচ্ছাসেবকের সহায়তায় কাঠের আগুনে রান্না করেন তারা, আধুনিক রান্নাঘর বা যন্ত্রপাতি ছাড়াই। তিনি বলেন, কখনও ৫০০ জনের খাবার তৈরি করি, কিন্তু ৬০০ জন হাজির হয়। প্রতিদিনই প্রয়োজন বেড়ে চলেছে। সীমান্ত বন্ধ থাকলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।
মাঠে আটা উধাও, বেকারি বন্ধ, এমনকি সাধারণ সবজিও এখন বিলাসিতা। ফলে কমিউনিটি কিচেনই এখন লাখো গাজাবাসীর একমাত্র খাবারের ভরসা।
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের বাসিন্দা আলা আবু আমিরাও একই কষ্টের কথা জানান। তিনি বলেন, কিছুক্ষণ দেরি করলেই আর খাবার পাওয়া যায় না। মানুষ ঠেলাঠেলি করে, পড়ে যায়। এক শিশুকে আহত হতে দেখেছি, একটি মেয়েশিশু গরম হাঁড়ির ছ্যাঁকায় পুড়ে গেছে।
কখনও আধা সেদ্ধ ভাত, কখনও বাসি মটরশুঁটি বা বিনের টিনজাত খাবার—পেটে চালানোই কঠিন হয়ে উঠেছে।
আব আমিরা আরও বলেন, কিন্তু আমাদের আর কোনও উপায় নেই। ক্ষুধা সবকিছু ভেঙে দেয়।
তবু হার মানতে রাজি নন রায়ালা। বললেন, আগামীকাল আরও ভোরে যাব, হয়তো একটা প্লেট ভাত পাব। আমরা শুধু সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই।
সূত্র: এএফপি