ইরানের সমর্থনপুষ্ট ইরাকের শক্তিশালী মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো প্রথমবারের মতো নিরস্ত্র হওয়ার কথা ভাবছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ক্রমবর্ধমান হুমকি এড়াতেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে জানিয়েছেন ইরাকের ১০ জন সিনিয়র কমান্ডার ও সরকারি কর্মকর্তা। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে আলাপকালে এই কর্মকর্তারা জানান, ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানির সঙ্গে মিলিশিয়া নেতাদের আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। ইরানের বিপ্লবী গার্ডস (আইআরজিসি) সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো মার্কিন দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত।
ট্রাম্প প্রশাসন গত কয়েক মাস ধরে ইরাকি সরকারকে বারবার সতর্ক করেছে যে, ইরাকের ভূমিতে সক্রিয় মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো ভেঙে না দিলে যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলা চালাতে পারে। ইরাকের ক্ষমতাসীন জোটের নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ শিয়া রাজনীতিবিদ ইজ্জত আল-শাহবন্দার বলেন, মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো এখন জেদি অবস্থান নিচ্ছে না। তারা মার্কিন হুমকি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন।
কাতায়েব হিজবুল্লাহ, আল-নুজাবা, কাতায়েব সাইয়্যিদ আল-শুহাদা ও আনসার আল্লাহ আল-আওফিয়া—এই চার বড় মিলিশিয়া গোষ্ঠীর ছয় কমান্ডার রয়টার্সকে বলেন, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক সংঘর্ষ এড়াতে চান। কাতায়েব হিজবুল্লাহর এক কমান্ডার মুখোশ ও সানগ্লাস পরে বলেন, ট্রাম্প আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে আরও ভয়াবহ পর্যায়ে নিতে প্রস্তুত। আমরা সেই পরিস্থিতি এড়াতে চাই।
ইরানের সম্মতি ও ইরাকের কূটনীতি
মিলিশিয়া কমান্ডাররা জানান, তাদের প্রধান মিত্র ইরানের বিপ্লবী গার্ডসও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে সম্মতি দিয়েছে। ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ফারহাদ আলাউদ্দিন বলেন, সরকার ইরাকে সব অস্ত্র রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য জাতীয় পর্যায়ে সংলাপ চালাচ্ছে।
ইরাকের দুই নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রী সুদানি ইরাকের ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স নামের মিলিশিয়া জোটের সব গোষ্ঠীকে নিরস্ত্র করতে চাপ দিচ্ছেন। এই জোটে প্রায় ৫০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে এবং তাদের অস্ত্রভাণ্ডারে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমানবিরোধী অস্ত্র আছে।
মিলিশিয়াদের সরে যাওয়া ও নিরাপত্তা বাড়ানো
গত জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বেশ কিছু মিলিশিয়া গোষ্ঠী তাদের সদর দফতর খালি করছে এবং মসুল ও আনবারের মতো বড় শহরে তাদের উপস্থিতি কমিয়েছে। অনেক কমান্ডার তাদের মোবাইল ফোন, গাড়ি ও বাসস্থান ঘনঘন বদলাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার ভয়ে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, তারা ইরাকি সরকারকে মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে বলেছে। দফতরটি জানিয়েছে, এই বাহিনীগুলো ইরাকের সর্বাধিনায়কের কাছে জবাবদিহি করবে, ইরানের কাছে নয়।
ইরানের প্রতিরোধ অক্ষের দুর্বলতা
শাহবন্দার বলেন, ইরাকি সরকার এখনও মিলিশিয়া নেতাদের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছায়নি। নিরস্ত্রীকরণের প্রক্রিয়া এখনও আলোচনাধীন। বিবেচনাধীন বিকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করা বা ইরাকি সেনাবাহিনীতে একীভূত করা।
এই আলোচনা ইরানের জন্য একটি স্পর্শকাতর সময়ে এসেছে। গাজায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীরা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মুখে পড়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনও ইরানের প্রভাব কমিয়ে দিয়েছে।
ইরাকের দ্বিধা ও মার্কিন চাপ
ইরাক যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান—দুই মিত্রের সঙ্গেই ভারসাম্য রেখে চলতে চাইছে। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হুসেনের পতনের পর ইরানের অর্থায়ন ও সামরিক সহায়তায় গড়ে ওঠা মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো এখন ইরাকি সেনাবাহিনীর সমান শক্তিশালী।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ গত ১৬ মার্চ সুদানিকে ফোন করে মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা চালানো থেকে বিরত রাখতে বলেছেন। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইরাকভিত্তিক মিলিশিয়ারা ইসরায়েলের ওপর ড্রোন ও রকেট হামলা চালিয়েছে। গত বছর জর্ডানে একটি ড্রোন হামলায় তিন মার্কিন সেনা নিহত হয়।
সুদানির সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা ইব্রাহিম আল-সুমাইদি ইরাকের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমকে বলেন, যদি আমরা স্বেচ্ছায় মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো ভেঙে না দিই, তাহলে বাইরে থেকে জোর করে ভাঙা হতে পারে।