সিরিয়ার সরকার দেশের পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা অভিযান শেষ করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এই অঞ্চলটি সাবেক নেতা বাশার আল-আসাদের অনুগতদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। সোমবার এক বিবৃতিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হাসান আবদুল গনি বলেছেন, লাতাকিয়া ও তারতুস প্রদেশে নিরাপত্তা হুমকি নিরপেক্ষ করা হয়েছে। কয়েক দিনের রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। যাদের মধ্যে অনেকেই বেসামরিক নাগরিক। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
গনি বলেন, নিরাপত্তা হুমকি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে বলে আমরা সামরিক অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করছি। আমরা ক্ষমতাচ্যুত শাসনব্যবস্থা ও তাদের কর্মকর্তাদের আক্রমণ মোকাবিলা করতে পেরেছি এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে সরিয়ে দিয়েছি।
সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস সোমবার জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া সহিংসতায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। এই সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক, যারা নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের মিত্র গোষ্ঠীর হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। এই সহিংসতা আলাওয়ি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে ঘটেছে। এই এলাকায় ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগতরা বসবাস করেন। আল জাজিরা এই প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।
সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন নেতা ও হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা রবিবার সহিংস সংঘাতের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নতুন শাসকদের কর্তৃত্ব লঙ্ঘনকারী যে কাউকে জবাবদিহি করা হবে। আল-শারার দফতর আরও জানিয়েছে, উভয় পক্ষের সংঘাত ও হত্যাকাণ্ড তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
হাসান আবদুল গনি সোমবার বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনী তদন্ত কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা করবে এবং ঘটনার পরিস্থিতি উন্মোচন, তথ্য যাচাই ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পূর্ণ সহায়তা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা সাবেক শাসনব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ ও তাদের কর্মকর্তাদের আক্রমণ মোকাবিলা করতে পেরেছি। আমরা তাদের অভিযানের উপাদান ধ্বংস করেছি এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছি। বেশিরভাগ প্রধান সড়ক নিরাপদ করা হয়েছে।
গনি বলেন, আমরা স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনা এবং নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা সুদৃঢ় করার পথ প্রশস্ত করছি। সাবেক সরকারের অবশিষ্টাংশের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া এবং ভবিষ্যতের যেকোনও হুমকি দূর করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে ডিসেম্বরে আল-আসাদের পতনের পর কয়েক সপ্তাহের আপেক্ষিক শান্তির পর সিরিয়ায় আবারও অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা বাড়তে শুরু করেছে। নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, তারা রাজধানী দামেস্কে একটি নিরাপত্তা চেকপোস্টে রাতে হামলা প্রতিহত করেছে।
আল জাজিরার রেসুল সারদার দামেস্ক থেকে জানান, দুজন হামলাকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা একটি সরকারি ভবন লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করছিল। নিরাপত্তা বাহিনীর বরাত দিয়ে তিনি বলেন, অন্যান্য বন্দুকধারী পালাতে সক্ষম হয়েছে। সারদার বলেন, এটা এখনও স্পষ্ট নয় যে হামলার চেষ্টাকারীরা সাবেক শাসনব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ, নাকি আলাদা কোনও গোষ্ঠী।
ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় অঞ্চলে সংঘাত শুরু হয় গত সপ্তাহে। ওই সময় আল-আসাদ সমর্থক বাহিনী নতুন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর সমন্বিত হামলা চালায়। এই হামলার জেরে প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যখন সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের হাজার হাজার সশস্ত্র সমর্থক উপকূলীয় অঞ্চলে জড়ো হয়। আনুমানিক ১ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে, যাদের মধ্যে অনেকেই নির্বিচারে হামলার শিকার হয়েছেন।
আসাদের দীর্ঘদিনের মিত্র ইরান সোমবার সহিংসতায় তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। সৌদি মালিকানাধীন আল-আরাবিয়া টিভি চ্যানেলসহ বিভিন্ন মিডিয়া প্রতিবেদনে ইরান ও তাদের মিত্র গোষ্ঠীকে এই সহিংসতার পেছনে থাকার অভিযোগ করা হয়েছে।
আল-শারা সহিংসতার জন্য ক্ষমতাচ্যুত শাসনব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ ও তাদের পেছনে থাকা বিদেশি শক্তির নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও দেশকে গৃহযুদ্ধে ফেলার চেষ্টাকে দায়ী করেছেন। আঞ্চলিক মিডিয়াগুলো তখন তেহরানের দিকে আঙুল তুলেছে।
তবে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসমাইল বাগায়ি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সিরিয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ হাস্যকর ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য। আমরা মনে করি, ইরান ও ইরানের বন্ধুদের দিকে আঙুল তোলা ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক। আলাওয়ি, খ্রিস্টান, দ্রুজ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার কোনও যৌক্তিকতা নেই। এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে মানুষের আবেগ ও বিবেককে আহত করেছে।
সিরিয়ার দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের সময় তেহরান বাশার আল-আসাদকে সামরিক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি শুক্রবার বলেছেন, এইচটিএসের ক্ষমতা দখলের পর থেকে তেহরান সিরিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষক হিসেবে রয়ে গেছে। বর্তমান সিরীয় সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই এবং এই বিষয়ে আমরা তাড়াহুড়ো করছি না।