X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

গাজায় ৭৫ বছরের লুকানো সত্য: পশ্চিমা মিডিয়ার দ্বিচারিতা ও ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:৩১আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:৩১

গত ৭৫ বছর ধরে গাজা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার দ্বিচারিতা এবং ইসরায়েলের প্রোপাগান্ডা মেশিনের প্রভাব বিশেষজ্ঞদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বিশ্বব্যাপী এই অঞ্চলের পরিস্থিতি যেভাবে তুলে ধরা হয়, তা শুধুই ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান প্রকাশ করে। ফিলিস্তিনিদের মানবিক বিপর্যয়কে আড়াল করে এই ঘটনাগুলোকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদ প্রায় ৫০ বছর আগে বলেছিলেন, ‘আপনি অন্য কাউকে নির্যাতন করতে পারেন না শুধু এজন্য যে একসময় আপনিও নির্যাতিত ছিলেন। এর একটি সীমা থাকা উচিত।’ কিন্তু সেই সীমা বহু আগেই অতিক্রম করেছে ইসরায়েলের প্রোপাগান্ডা। ইসরায়েলের সহিংসতাকে পশ্চিমা মিডিয়া বৈধতা দেয়। ক্রমশ তা মানুষের আস্থা হারাচ্ছে।

মিথ্যা সংবাদ ও পশ্চিমা মিডিয়ার ভূমিকা

২০২৩ সালে হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের কফার আজা কিব্বুৎসে ৪০টি শিশুর শিরচ্ছেদের খবর মিথ্যা ছিল। তবু তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এটিকে সত্য বলে দাবি করেছিলেন। যদিও পরে তিনি তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি পশ্চিমা নেতৃত্বের গাজা নিয়ে প্রচলিত প্রোপাগান্ডার একটি অংশ। অথচ গাজার রাফাহতে সন্তানের মাথাহনী দেহ ধরে থাকা একজন পিতার ঘটনাটি কোনও পশ্চিমা মিডিয়ায় শিরোনাম হয়নি। পশ্চিমা মিডিয়া যেনও ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের মানবিক বিপর্যয়কে উপেক্ষা করে।

যুক্তরাষ্ট্রের আইন অধ্যাপক খালেদ বেইডুন এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, যেখানে ইসরায়েলের শিশুদের মৃত্যু নিয়ে মিথ্যা সংবাদ গৌরবের সঙ্গে প্রচারিত হয়, সেখানে ফিলিস্তিনের শিশুদের প্রকৃত মৃত্যু কোনও গুরুত্ব পায় না।

গাজায় ৭৫ বছরের লুকানো সত্য: পশ্চিমা মিডিয়ার দ্বিচারিতা ও ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা

ফিলিস্তিনিদের বিপন্নতা ও শিশুদের মানবিক সংকট

ইউনিসেফ ২০২৩ সালে জানিয়েছিল যে, ইসরায়েলের আক্রমণে কমপক্ষে ১৩ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনা কখনোই বড় শিরোনামে আসে না। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে এক হাজার ১০০ সংবাদ নিবন্ধের মধ্যে মাত্র দুটিতে ফিলিস্তিনি শিশুদের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনে শিশুদের ক্রমাগত মৃত্যুর কথা কোনও আলোচনায় স্থান পায় না।

এডওয়ার্ড সাঈদের লেখা ১৯৭৫ সালের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর এই ধারাবাহিক মানবিক অপমানের কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘আরবদের সবসময় জনসমষ্টি হিসেবে দেখানো হয়, যাদের কোনও ব্যক্তিত্ব নেই। এই চিত্র থেকে মনে হয় আরবরা সবসময় এক অন্ধকারময় ভবিষ্যতের হুমকি।’

পশ্চিমা মিডিয়ার বৈষম্যমূলক প্রচারণা

যুক্তরাজ্যের ডেটা সাংবাদিক মোনা চালাবি পশ্চিমা মিডিয়ায় ফিলিস্তিনিদের উপস্থাপনায় এই বৈষম্য চিহ্নিত করেছেন। তিনি একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, ইসরায়েলি মৃত্যু যখন মানবিকতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়, তখন ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুকে প্রতিশোধের প্রসঙ্গে উপস্থাপন করা হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ইসরায়েলি ভুক্তভোগীদের সবসময় ভালোবাসা ও পরিচয়সহ তুলে ধরা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা তাদের মৃত্যু পরেও শেকড়হীন।’

 

 
 
 
 
 
View this post on Instagram
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

A post shared by Mona Chalabi (@monachalabi)

বিশেষ করে বিবিসি নিউজে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের নিয়ে ভাষাগত পার্থক্য প্রমাণ করে কীভাবে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে হামাসের লড়াইকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের মানবিক বিপর্যয়কে ‘দুঃখজনক ভুল’ হিসেবে তুলে ধরা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ইন্টারসেপ্টের এক গবেষণা দেখিয়েছে, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে ফিলিস্তিনিদের চেয়ে ইসরায়েলিদের নাম বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি ইসরায়েলের হত্যাকাণ্ডের বিপুল পরিসংখ্যান থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রবল।

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতে প্রজন্মের পরিবর্তন

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা এই দ্বন্দ্বে নতুন প্রজন্ম এখন অনেক বেশি সচেতন ও সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভগুলো পশ্চিমা মিডিয়াতে ‘হুমকি’ হিসেবে তুলে ধরা হলেও শিক্ষার্থীরা নিরলসভাবে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা পশ্চিমা মিডিয়ার এই দ্বিচারিতা ও ইসরায়েলপন্থি প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বাইডেনের ৫০ শতাংশ ভোটার মনে করেন যে, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।

এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, ইসরায়েলের আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব তাদের নিজেরই একটি ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তার লেখায় ইসরায়েলি সমাজের মধ্যে বিদ্যমান মিথ্যার পর্দা উন্মোচন করেছেন এবং এই বিপজ্জনক প্রবণতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সাঈদের ভাবনা অনুযায়ী, এই মিথ্যার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া সমাজ একদিন নিজেদের করুণ পরিণতি অনুভব করবে।

ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায় লিখতে হবে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের প্রেক্ষাপটে, যেখানে ফিলিস্তিনি মানবিকতা ও অধিকারের চেয়ে মিডিয়ার দ্বিচারিতা এবং ইসরায়েলের প্রোপাগান্ডাই কেন্দ্রে থাকবে। তবে, একটি প্রজন্ম এই অসম যুদ্ধের গল্পটিকে পাল্টানোর জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র: ডন

/এএ/
সম্পর্কিত
গাজায় ইসরায়েলের পূর্ণ অবরোধবিমান হামলার চেয়ে দুর্ভিক্ষকে বেশি ভয় পাচ্ছেন গাজাবাসী
ইসরায়েলকে অর্থ দেওয়া নিয়ে মুফতি আলাউদ্দিনের দাবি বানোয়াট: সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টস
ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামোতে হামলার পরিকল্পনা বাতিল করেনি ইসরায়েল
সর্বশেষ খবর
‘আদালতে আসামিকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে তোলার বিষয়টি জেল অথরিটির সিদ্ধান্ত’
‘আদালতে আসামিকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে তোলার বিষয়টি জেল অথরিটির সিদ্ধান্ত’
অপহরণ ও ধর্ষণের প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ সমাবেশ
অপহরণ ও ধর্ষণের প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ সমাবেশ
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেকোনও সময় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল: চিফ প্রসিকিউটর
জুলাই-আগস্ট গণহত‍্যাশেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেকোনও সময় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল: চিফ প্রসিকিউটর
৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম, দাবি না মানলে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’
৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম, দাবি না মানলে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’
সর্বাধিক পঠিত
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, বিপাকে পুলিশ
আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, বিপাকে পুলিশ
প্রধানমন্ত্রী নয়, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার চায় এনসিপি: নাহিদ ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী নয়, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার চায় এনসিপি: নাহিদ ইসলাম
যেসব পদক্ষেপে ঘুরে দাঁড়ালো রিজার্ভ
যেসব পদক্ষেপে ঘুরে দাঁড়ালো রিজার্ভ
বাংলাদেশ ভ্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা জারি
বাংলাদেশ ভ্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা জারি