গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন অবসানের পর ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীরের শাসক গোষ্ঠী একীভূত হতে আলোচনায় বসতে পারে। পাঁচটি ফিলিস্তিনি সূত্র জানিয়েছে, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গভীর বিভাজন পুনর্মিলনের আলোচনার অগ্রগতিকে সীমিত করতে পারে। তবে এসব বৈঠক ইঙ্গিত দিচ্ছে গাজায় যুদ্ধ শেষ হলেও হামাসের প্রভাব থাকবে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
গাজা ও পশ্চিম তীরের কর্মকর্তারা বলেছেন, জুনের মাঝামাঝি চীনে এই আলোচনা শুরু হতে পারে। এর আগে এই ইস্যুতে দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, একটি চীনে এবং অপরটি রাশিয়া। এই বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীরা যখন গাজায় হামাস-ইসরায়েলের একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করছেন তখন চীনে হামাস-ফাতাহ বৈঠক আয়োজনের খবর সামনে এলো। উভয় প্রক্রিয়াতেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উঠে আসছে যুদ্ধের পর কীভাবে উপত্যকাটি শাসন করা হবে।
একাধিক পশ্চিমা দেশ হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে তাদের গোষ্ঠীটির হামলায় ১২০০ জন নিহতের আগে থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এই হামলার পরই গাজায় আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েল।
ইসরায়েলি অভিযানে হামাসের সামরিক শক্তির ক্ষয় হয়েছে। তবে ইসরায়েলের দখলে থাকা পশ্চিম তীরের শাসক গোষ্ঠী ফাতাহ দলের সঙ্গে হামাস কর্মকর্তাদের বৈঠক ইঙ্গিত দিচ্ছে যুদ্ধের পরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিয়ে তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হামাস সূত্র এমনটিই জানিয়েছে রয়টার্সকে।
যুদ্ধ শুরুর পূর্বে গাজা শাসন করছিল হামাস। সূত্র মতে, গোষ্ঠীটি স্বীকার করছে এক সময় গাজায় যুদ্ধ শেষ হলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যে নতুন সরকার হবে, সেটির অংশ তারা হতে পারবে না।
ওই সূত্র ও হামাসের সিনিয়র কর্মকর্তা বাসিম নাইম বলেছেন, তারা চায় পশ্চিম তীর ও গাজায় একটি নতুন টেকনোক্র্যাটি প্রশাসন গড়ে তুলতে ফাতাহ রাজি হোক। যা হবে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতা।
চীনে প্রথম দফার আলোচনায় অংশ নেওয়া নাইম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ফিলিস্তিনি সত্তার পুনর্গঠনের জন্য আমরা রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব ও রাজনৈতিক ঐক্যের কথা বলছি। সরকারে হামাসের থাকা বা না থাকা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দাবি না। পুনর্মিলনের জন্য এটিকে হামাস কোনও শর্ত হিসেবেও দেখছে না।
হামাসের বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতার মতো নাইমও গাজার বাইরে অবস্থান করছেন।
প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হামাসের টিকে থাকার সম্ভাবনা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য অপ্রিয় ইস্যু।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধের লক্ষ্য হিসেবে হামাসকে নির্মূল করার লক্ষ্যের কথা বললেও বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন যে, যুদ্ধবিরতির পর হামাসের অস্তিত্ব কিছু মাত্রায় থেকে যাবে।
যুদ্ধ শেষ হলে গাজা শাসনে হামাসের যেকোনও ভূমিকার বিরোধিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এরপরও কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তা একান্ত আলাপে হামাসকে নির্মূলে ইসরায়েলের সফল হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। এক সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা ১৪ মে বলেছিলেন, ইসরায়েল সর্বাত্মক জয় পাবে বলে মনে করে না।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র পিটার লারনার বলেছেন, হামাসের প্রত্যেক সদস্যকে হত্যা করা অবাস্তব এবং তা সেনাবাহিনী লক্ষ্য নয়। কিন্তু শাসক গোষ্ঠী হিসেবে হামাসের সক্ষমতা একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়া একটি অর্জনযোগ্য সামরিক লক্ষ্য।
যুদ্ধ শেষে পশ্চিম তীরের শাসকগোষ্ঠী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের গাজা শাসনের প্রতি সমর্থন রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। এই প্রশাসনের নেতৃত্বে রয়েছেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তার শাসন পশ্চিম তীরে সীমাবদ্ধ এবং রামাল্লা-কেন্দ্রিক। ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে বৈশ্বিকভাবে তারা স্বীকৃত এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে নিরাপত্তা সহযোগিতা পায়।
আব্বাসের আগে ফাতাহ গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইয়াসির আরাফাত। তিনি ছিলেন অবিসংবাদিত ফিলিস্তিনি নেতা। হামাসের উত্থানের আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে ফাতাহ একাই লড়াই করে আসছিল।
২০০৭ সাল পর্যন্ত গাজা শাসন করেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। এক বছর পর পার্লামেন্টারি নির্বাচনে ফাতাহকে হারিয়ে গাজার শাসন নিজেদের হাতে নেয় হামাস। এটিই ছিল ফিলিস্তিনিদের শেষ ভোট।
পাঁচটি সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছে, আলোচনা চললেও দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের কারণে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের একক শাসনের চুক্তিতে পৌঁছার সম্ভাবনা কম। এই অবস্থানকে সমর্থন করছেন বিশেষজ্ঞরাও।
কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের সিনিয়র ফেলো ইয়েজিদ সাইয়াহ বলেন, পুনর্মিলনে আমার প্রত্যাশা ন্যূনতম বা কম।
ফিলিস্তিনিরা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের দখলকৃত সব ভূখণ্ড নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেন। ওই সময় গাজা উপত্যকা ও পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীর দখল করেছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
আয়ারল্যান্ড, স্পেন, নরওয়েসহ বিশ্বের ১৪৩টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেও বছরের পর বছর ধরে সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন অধরা রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপন সম্প্রসারণ করেছে এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে আসছে।