X
সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২

কে এই হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০:১৩আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:২২

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করে হামলা চালায় সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস। আকস্মিক এ হামলায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল ইসরায়েলবাসী, হতভম্ব ছিল বিশ্ব। এ হামলায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং আরও ২৪০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। এরপর গাজায় পাল্টা বিমান হামলা ও স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী, হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে গাজায় হামাসের শীর্ষনেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে। কিন্তু দুই মাসের বেশি সময় পরও তাকে খুঁজে পায়নি ইসরায়েলি সেনারা।  বুধবার (১৯ ডিসেম্বর) তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। এতে হামাস নেতার জীবন ও কাজের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।

ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের কাছে গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের একজন নেতা সিনওয়ার। তিনি ২০১৩ সাল থেকেই সংগঠনটির নীতিনির্ধারক বোর্ডের সদস্য। হামাসের সামরিক শাখা কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ ও তার ডেপুটি মারওয়ান ইসার এবং সিনওয়ার ৭ অক্টোবরের হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। গাজায় হামাসকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ গাজায় বসবাস করেন না।

তাদের পরিকল্পনায় হামাসের যোদ্ধারা গাজার সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্তে আধুনিক সব প্রযুক্তিকে ফাঁকি দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দেশ ইসরায়েলের হামলা চালায়। এতে রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন বিশ্বনেতারা। তাদের হামলার এই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি এতটাই গোপনে ও সতর্কতার সঙ্গে করা হয়েছিল যে হামলার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে মোসাদ কোনও উড়ো খবর পর্যন্ত পায়নি। এ ঘটনার পর খ্যাতিমান এই সংস্থার কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন।

যদিও এই হামলার জবাবে ওই দিনই পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তবে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের জান-মালের ক্ষতি ছাড়া হামাসের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও ক্ষতিই করতে পারেনি সেনারা।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই হামাস নেতার বড় একটি লক্ষ্য রয়েছে। কেননা, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং দেশটির অন্যান্য কর্মকর্তা তাদের পরিকল্পিত হত্যা তালিকায় সিনওয়ারের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। তাকে ‘মৃত্যুপথযাত্রী’ বলে অভিহিত করেছিলেন তারা।

রহস্যময় চরিত্র

আবু ইব্রাহিম নামেও পরিচিত সিনওয়ার। তাকে ঘিরে অগণিত গল্প রয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় রহস্যময় এক খলনায়ক রূপে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেচ নামে এক ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র সিনওয়ারকে ‘শয়তানের প্রতিচ্ছবি’ বলে বর্ণনা করেছেন। সিনওয়ারের পরিকল্পিত হামলাকে ‘জঘন্যতম’ বলে বর্ণনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এদিকে, হামাসকে পরাজিত করা না গেলে ‘ইউরোপ পরবর্তী টার্গেট হবে এবং কেউই নিরাপদ থাকবে না’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নেতানিয়াহু। হামাসকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার তালিকাভুক্ত করার সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়েছে তার সরকার।

জন্ম

বিশ্বের কাছে ‘শয়তানের প্রতিচ্ছবি’ হিসেবে ইসরায়েল যাকে তুলে ধরছে, সেই সিনওয়ার ১৯৬২ সালে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের একটি শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। ইসরায়েলের কারণে ১৯৪৮ সালের নাকবা বা বিপর্যয়ের সময় ওই শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার পরিবার। এর আগে, পরিবারটি মাজদাল নামে একটি ফিলিস্তিনি গ্রামের বাসিন্দা ছিল, যেটি ইসরায়েলি আশকেলন শহর তৈরির জন্য ধ্বংস করে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।

হামাসের সঙ্গে পরিচয়

সিনওয়ারের বয়স ২০-এর গণ্ডি পেরোনোর আগেই ইসরায়েলি সেনাদের হাতে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন। ১৯৮২ সালে ‘ইসলামি কার্যকলাপে’ অংশ নেওয়ার দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৮৫ সালে আবারও গ্রেফতার হন তিনি। দ্বিতীয়বার কারাবাসের সময় হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং তার ঘনিষ্ঠ হন সিনওয়ার।

হামাসের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে ২৫ বছর বয়সেই আল-মাজদ গ্রুপের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন সিনওয়ার। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িত ফিলিস্তিনিদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি।

তার নিষ্ঠুরতার চরিত্র তুলে ধরতে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেটের সাবেক কর্মকর্তা মিচা কোবির বলেন, ১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে কথিত এক তথ্যদাতার ভাইকে দিয়ে এক অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জীবিত কবর দেওয়ানোর বিষয়ে গর্ব করেছিলেন সিনওয়ার।

২৬ বছর বয়সে দুই ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা এবং আরও ১২ ফিলিস্তিনিকে হত্যার পরিকল্পনা করার অভিযোগে ১৯৮৮ সালে তাকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। এ সময় চারটি ধারায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

পরে কারাগারে টানা ২২ বছর তিনি কঠোরভাবে শৃঙ্খল জীবনযাপন করেন। হিব্রু ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে ও পড়তে শেখেন। হয়ে ওঠেন কারাবন্দিদের নেতা। পরিণত হন কারাগারের কর্মীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, কারাগারে থাকাকালীন ইসরায়েলি সরকারের একটি মূল্যায়নে সিনওয়ারকে ক্যারিশমেটিক, নিষ্ঠুর, কারসাজিতে পটু, অল্পতে সন্তুষ্ট, ধূর্ত এবং রহস্যময় বলে বর্ণনা করা হয়।

সাইকোপ্যাথ?

কারাগারে চারবার সিনওয়ারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির এক গবেষক এহুদ ইয়ারি। বিবিসির কাছে সিনওয়ারকে একজন সাইকোপ্যাথ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। এহুদ বলেছিলেন, “বলতে গেলে ‘সিনওয়ার একজন সাইকোপ্যাথ, ফুল স্টপ।’ এমন বলাটা ভুল হবে। কেননা, এমন বললে আপনি তার এই অদ্ভুত ও জটিল চরত্রিটিকে হারিয়ে ফেলবেন।”

উত্থান

২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর গিলাদ শালিত নামে হামাসের হাতে জিম্মি এক ইসরায়েলি সেনার বিনিময়ে এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছিল ইসরায়েল, যাদের মধ্যে সিনওয়ারও ছিলেন।

কারাগারের বাইরে আসতে না আসতেই হামাসে নিজের জায়গা দ্রুত পাকাপোক্ত করে নেন সিনওয়ার। তার নাম নেতানিয়াহুর ডেস্কে হত্যার তালিকায় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তবে অভিযোগ রয়েছে, বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে সিনওয়ারকে হত্যার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। ২০১৩ সালে তিনি গাজা উপত্যকায় হামাসের নীতিনির্ধারক বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০১৭ সালে গাজায় হামাসের শীর্ষ নেতা হন তিনি। এর আগে এই দায়িত্ব পালন করছিলেন হামাসের বর্তমান রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ।

গাজায় হামাসের প্রধান হিসেবে সিনওয়ার সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের বিষয়ে মতবিরোধের পরে মিসরীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার এবং ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনসহ বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করেছিলেন। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও একত্রিত হওয়ার আলোচনায় ছিলেন তিনি। বর্তমানে হামাসে ইসমাইল হানিয়াহর পরেই সিনওয়ারের অবস্থান।

বন্দিবিনিময়ে ভূমিকা

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে জিম্মি ও বন্দিবিনিময় নিয়ে বর্তমান আলোচনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন সিনওয়ার।

তবে অন্যান্য বিশ্লেষক মনে করছেন, ইসরায়েলি ও মার্কিন কর্মকর্তারা মন থেকে শান্তি চাইছেন না। তাদের দাবি, সিনওয়ার ও হামাসকে নিহিলিস্টি বা ধ্বংসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের হিংস্র ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করছে ইসরায়েল ও পশ্চিমারা। হামাসের যেকোনও বৈধ রাজনৈতিক লক্ষ্যকে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে—হোক তা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি বা দখলকৃত পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ বন্ধ করার মতো বৈধ রাজনৈতিক লক্ষ্য।

/এএকে/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ইয়েমেনে হামলার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ সীমিত করবে যুক্তরাষ্ট্র
কাশ্মীর সীমান্তে চতুর্থ রাতের মতো ভারত-পাকিস্তানের গুলি বিনিময়
দক্ষিণ বৈরুতে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র মজুতে ইসরায়েলের হামলা
সর্বশেষ খবর
‘জনমানুষের ঐক্যের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রসর হতে পারবো’
‘জনমানুষের ঐক্যের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রসর হতে পারবো’
ইয়েমেনে হামলার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ সীমিত করবে যুক্তরাষ্ট্র
ইয়েমেনে হামলার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ সীমিত করবে যুক্তরাষ্ট্র
গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একজনের মৃত্যু
গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একজনের মৃত্যু
অপেক্ষা ঘুচিয়ে আসছে ‘জয়া আর শারমিন’
অপেক্ষা ঘুচিয়ে আসছে ‘জয়া আর শারমিন’
সর্বাধিক পঠিত
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নূরজাহানের পদত্যাগ দাবি
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নূরজাহানের পদত্যাগ দাবি
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা, কেড়ে নেওয়া হলো মাইক
মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা, কেড়ে নেওয়া হলো মাইক
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস