ভারতের ১৮ তম লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জোট ‘ইন্ডিয়া’র অন্যতম শরিক বাম দলের ৩টি আসন বেড়েছে। তারপরও দেশজুড়ে তাদের ভোটের হার কমেছে! ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় ভোটের শতাংশের নিরিখে বামেদের গ্রাফ ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছে। এবারের লোকসভা ভোটে সেটা আবারও প্রমাণ হলো।
কেরল ছাড়াও বাংলা ও ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন ধরেই শাসন ক্ষমতার বাইরে থাকা বামেরা আশা করেছিলেন এবারে ইন্ডিয়া জোটের হাত ধরে লোকসভায় তাদের আসন সংখ্যাকে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু ফলপ্রকাশের পর দেখা গেল সে আশা এবারও পূরণ হল না সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজাদের।
গতবারের নির্বাচনে পাওয়া ৩টি আসন ধরে রেখে অতিরিক্ত মাত্র ১টি আসন পেয়েছে সিপিএম। সিপিআই গতবারের মতোই ২টি আসনে জিতেছে। আর বিহারে এবার ২টি আসন জিতেছে সিপিআই (এমএল) লিবারেশন। এই মোট ৮ আসন নিয়ে এবার লোকসভায় বসতে যাচ্ছে বামেরা।
গত নির্বাচনে সিপিএম তামিলনাড়ুতে ২টি আর কেরালায় ১টি আসন জিতেছিল। আর সিপিআই তামিলনাড়ুতে ২টি আসন জিতেছিল। সিপিএম এবার দেশজুড়ে ৫২টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। তার মধ্যে এবার দক্ষিণ ভারতের বাইরে একমাত্র রাজস্থানে তাদের প্রার্থী অমেরা রাম জিতেছে। বাংলা ও ত্রিপুরায় তারা এবার কোনও আসনই দখল করতে পারেনি। অপরদিকে, সিপিআই ৩০টি আসনে প্রার্থী দিলেও তামিলনাড়ুর তিরুপুর এবং নাগাপট্টিনাম আসনে জিতেছে। ২০১৯ সালেও এ দুটি আসনে জিতেছিল তারা। সিপিআই (এমএল) লিবারেশন বিহারের ৩টি আসনে প্রার্থী দিয়ে আরা ও কারাকাট লোকসভায় জয় পেয়েছে।
কমিউনিস্ট দলগুলির মধ্যে প্রাচীনতম, সিপিআই, ১৯৬২ সালের লোকসভা নির্বাচনে সর্বাধিক ৯.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। কিন্তু দলের বিভক্তির পরে সিপিএম তৈরি হলে তাদের ভোটের হার কমতে থাকে। ১৯৬৭ সালে মাত্র ৫ শতাংশের বেশি এবং ১৯৯১ সালে প্রায় ২.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল সিপিআই। ১৯৯০ এবং ২০০০ এর দশকে, বাম দলগুলো ভারতের রাজনীতিতে একটি স্থির অবস্থান বজায় রেখেছিল। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে সিপিঅএম ৩২টি আসন জিতেছিল, যেখানে সিপিআইয়ের ছিল ১২ আসন। অটল বিহারী বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার পরে যে ইউডিএফ সরকার গঠিত হয়েছিল, তাতে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নাম প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য উঠেছিল। সিপিএম এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই একটি ভুল সিপিএমকে পতনের দিকে নিয়ে যায়। ২০০৪ সালে লোকসভা ভোটে বাম দলগুলো ভালো ফলাফল করে। সেবার সিপিএম ৪৩ টি আসনে জয় পেয়েছিল। ভোটের হার ছিল ৫.৪-শতাংশ। সিপিআই পেয়েছিল ১০ আসন। তারা ১.৪১-শতাংশ ভোট পায়। অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক (এআইএফবি) এবং বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল (আরএসপি) তিনটি করে আসন পেয়েছিল। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম ৫.৩৩ শতাংশ ভোট পেলেও, মাত্র ১৬টি আসন জিতেছিল। সিপিআই সেবার ১.৪৩-শতাংশ ভোট পেয়ে চারটি আসন জিতেছিল। ফরওর্য়াড ব্লক ২টি আসন জিতেছিল। সিপিএম ১৯৭১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৫ শতাংশের বেশি ভোটের হার নিজেদের পক্ষে বজায় রাখতে পেরেছিল।
২০০৯ এবং ২০১৯ এর মধ্যে বাম দলগুলোর পতন শুরু হয়। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে হার, ২০১৮ সালে বিজেপির কাছে ত্রিপুরার হার। ২০১৪ সালে, যখন বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে, তখন সিপিএমের ৯ জন সংসদ সদস্য এবং ৩.২৫-শতাংশ ভোট ছিল। সিপিআই এবং আরএসপি পেয়েছিল যথাক্রমে ০.৭৮ এবং ০.৩ শতাংশ ভোট। গতবারের লোকসভা ভোটে সিপিএম ১.৭৭ শতাংশ,সিপিআই ০.৫৯, আরএসপি ০.১২ শতাংশ, ফরওর্য়াড ব্লক ০.০৫ শতাংশ আর সিপিআই (এমএল) লিবারেশন ০.২২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর এবারের লোকসভা ভোটে বাম দলগুলো সবচেয়ে কম আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। ভারতজুড়ে সিপিএম ১.৭৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। সিপিআই ০.৪৯ শতাংশ এবং সিপিআই (এমএল) লিবারেশন ০.২৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে।