X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

ভারতের হিজাব বিতর্কে বিভাজনের রেখা শ্রেণিকক্ষেও

জাহিদুল ইসলাম জন
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:২৩আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২১:০৮

হিজাব পরার অধিকারের বিরুদ্ধে যারা স্লোগান দিচ্ছে তাদের সঙ্গে একই ক্লাসে বসতে হচ্ছে সায়মাকে। ২০ বছরের এই শিক্ষার্থী ভারতের কর্ণাটকের বাসিন্দা। গত সপ্তাহে আরও কয়েকজন মুসলিম শিক্ষার্থীর সঙ্গে হিজাব পরে কলেজে গেলে তাদের উদ্দেশ্যে বিক্ষোভ করে কয়েকশ’ হিন্দু শিক্ষার্থী। গেরুয়া স্কার্ফ পরে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে হিজাবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে এসব শিক্ষার্থী। এই রঙের পোশাক সাধারণত হিন্দু ডানপন্থী গ্রুপগুলো ব্যবহার করে থাকে।

ক্লাসের একমাত্র মুসলিম শিক্ষার্থী সায়মা। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তিনি নিজের সহপাঠীদের অনেককেই দেখেছেন।

হিজাব পরায় ক্লাসে যেতে বাধা

ভারতে তুমুল বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে হিজাব। গত মাসে এই বিতর্কের শুরু। কর্ণাটকের উদুপি জেলার একটি সরকারি কলেজের ছয় শিক্ষার্থী হিজাব পরতে বাধা দেওয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের দাবি হিজাব পরে যাওয়ায় তাদের ক্লাসে যেতে দেওয়া হয়নি।

দ্রুতই ইস্যুটি বিভক্তি তৈরি করে। হিন্দু শিক্ষার্থীরা কলেজে গেরুয়া শাল পরা শুরু করে। উভয় পক্ষের ডানপন্থী গ্রুপগুলো উসকানিমূলক বিবৃতি দিতে শুরু করে। সহিংসতার আশঙ্কায় রাজ্য সরকার হাই স্কুল ও কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে দেয়।

কর্ণাটকের মুসলিম নারী শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে হিজাব পরতে পারবে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর এখন মীমাংসা হবে রাজ্যের উচ্চ আদালতে। সেখানে এই বিষয়ে শুনানি চলছে।

ঘৃণার পরিবেশ

বুধবার থেকে ক্লাসে ফিরছে কর্ণাটকের শিক্ষার্থীরা। উভয় পক্ষের তরুণরা এখন সহপাঠী ও বন্ধু বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে।

সায়মা বলেন, ‘আমার আশঙ্কা, এতে নিশ্চিতভাবে ক্লাসে ঘৃণার পরিবেশ তৈরি হবে। আমরা ভাবতে শুরু করবো সে একজন হিন্দু। আর সে কারণেই আমার বিরুদ্ধে। আর তারা চিন্তা করবে আমরা মুসলিম। আর সে কারণেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে।’

সায়মার কলেজেই পড়েন আকাঙ্ক্ষা হানচিনামাথ। গেরুয়া শাল পরে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন তিনি। এই শিক্ষার্থী বলেন, হিন্দু শিক্ষার্থীদের সমন্বিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিক্ষোভ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের দেখাতে চাই কলেজে ধর্ম টেনে আনলে কী হয়।’

কর্ণাটকের ওই অংশে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উগ্রবাদী তৎপরতা দেখা যায়। এই তৎপরতায় রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ছাত্র সংগঠন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ইসলামিক গোষ্ঠী পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া (সিএফআই)।

এক্ষেত্রে উদুপিতে বিক্ষোভকারী মেয়েদের সমর্থন করছে সিএফআই। আর গেরুয়া শাল নিয়ে বিক্ষোভকারীদের সমর্থন করছে বিজেপির ছাত্র সংগঠন। উদুপি থেকে নির্বাচিত বিজেপির আইনপ্রণেতা রঘুবীর ভাট বলেন, ‘সিএফআই-এর মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠন যদি মুসলিম শিক্ষার্থীদের সমর্থন করে, তাহলে আমরা এবং আমাদের মেয়েরা কেন নীরবে দেখবো?’ ভারতের হিজাব বিতর্কে বিভাজনের রেখা শ্রেণিকক্ষেও

বির্তক এবারই প্রথম নয়

কর্ণাটকের উপকূলীয় এলাকায় হিজাব বিতর্ক এবারই প্রথম নয়। এই অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলিম ডানপন্থী গ্রুপগুলো গত কয়েক দশক ধরেই সক্রিয়। তবে অতীতে এই ধরণের ইস্যু দ্রুত নিরসন হয়েছে বলে জানান প্রফেসর ফনিরাজ কে। তিনি একটি নাগরিক গ্রুপের সদস্য। এই গ্রুপটি রাজ্যটিতে সাম্প্রদায়িক ঘটনার ওপর নজর রাখে।

প্রফেসর ফনিরাজ কে ১৫ বছর আগে ম্যাঙ্গালোরে একই ধরনের আরেকটি বিক্ষোভের কথা স্মরণ করেন। সেই সময় পাঁচ দিনের মধ্যে কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষার্থীরা একটি মধ্যবর্তী সমাধান বের করে ফেলে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব ও মাথার টুপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার বিচ্ছিন্ন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে এবারের মতো বিস্ফোরণ ঘটেনি।’

কর্ণাটকে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফলে বিভিন্ন কলেজে হিজাব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম তৈরি হয়েছে। সায়মা যে কলেজে পড়েন সেটির মতো অনেক বেসরকারি কলেজ ক্লাসে হিজাব পরার অনুমতি দেয়।

আর সরকার পরিচালিত কলেজগুলো প্রতি বছরই নিয়ম পর্যালোচনা করে। স্থানীয় আইনপ্রণেতার নেতৃত্বাধীন ডেভেলপমেন্ট কমিটি ইউনিফর্মের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রথম বিক্ষোভ ছড়ায় যে উদুপি কলেজে সেখানকার কমিটির দায়িত্বে আছেন বিজেপির আইনপ্রণেতা রঘুবীর ভাট। কিন্তু তার সঙ্গে বিক্ষোভরত মেয়েদের অভিভাবক এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের আলোচনা অচলাবস্থায় পড়েছে।

ভয়, আতঙ্ক আর উসকানি

উদুপির একটি বেসরকারি কলেজে পড়েন রাশমিতা শেঠি। তিনি জানান, গত কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় তিনি এবং তার মুসলিম বন্ধুরা ভয়ে আছেন। তার কলেজে বেশ কয়েক জন মুসলিম শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে তারা হিন্দু শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েনি। তারপরও তিনি মনে করেন পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবে বদলেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা কখনও কোনও মেয়ে হিজাব পরেছে কিনা তা খেয়ালই করিনি। গরম লাগলে কেউ কেউ খুলেও ফেলেছে। এটা কখনও ইস্যু ছিল না।’

রাশমিতা শেঠি বলেন, ‘আমার মুসলিম বন্ধুরা আমাকে বলেছে, এটা সবসময়ই তাদের মনে থাকবে যে, এই তরুণ বয়সেই তাদের অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছে। আর এখন তাদের আলাদা করে দেখা হবে।’ তিনি বলেন, পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের উসকানিমূলক মন্তব্যে। এক বিজেপি নেতা হিজাব পরলে মুসলিম শিক্ষার্থীদের পাকিস্তান চলে যেতে বলেছেন। আরেক নেতা বলেছেন, কর্ণাটককে তালেবান রাজ্য বানানো ঠেকাতে কলেজে হিজাবের বিরোধিতা করা হবে।

শিক্ষার্থী আকাঙ্ক্ষা হানচিনামাথ জানান, বন্ধু বানাতে তিনি কখনও ধর্মের দিকে তাকাননি। তবে এবার আর পেছনে ফিরতে রাজি নন তিনি। আকাঙ্ক্ষা বলেন, ‘জানি এটা আমাদের বদলে দেবে। কারণ তারা ভাবছে, আমরা তাদের বিরোধিতা করছি। কিন্তু আমরা শুধু শৃঙ্খলা ও সমতা চাইছি, যে সবাই একই ইউনিফর্ম পরতে হবে।’

রাশমিতা শেঠি অবশ্য মুসলিম বন্ধুদের সমর্থন করছেন। কারণ তিনি মনে করেন হিজাব পরতে চাওয়ার দাবি ন্যায্য। তিনি বলেন, ‘মুসলিম মেয়েদের সঙ্গে স্লোগান না দিলেও এটা আমাকে বিব্রত করবে। এটা এমনই দ্বিধা। সে কারণে নীরবতা বেছে নিয়েছি আর বন্ধুদের সমর্থন করছি। এটাই আমার প্রতিবাদ।’

কর্ণাটক থেকে বিবিসি-র দিব্য আর্যের নিবন্ধ অবলম্বনে।

/এমপি/
সম্পর্কিত
চীনের অর্থনীতি আবারও চমকে দিলো বিশ্বকে
জেলেনস্কির অভিযোগ খারিজ করলো চীন
৭ ডলার চুরি করে ৮৪ হাজার ডলার হারালেন জাপানি বাসচালক
সর্বশেষ খবর
শিল্পীদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি ১০ প্রস্তাবনা
শিল্পীদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি ১০ প্রস্তাবনা
রোমে দ্বিতীয় দফার বৈঠকে বসছে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র
রোমে দ্বিতীয় দফার বৈঠকে বসছে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র
রিয়ালে কোচ হয়ে ফিরছেন ক্লপ?
রিয়ালে কোচ হয়ে ফিরছেন ক্লপ?
এক সংবাদ একই শিরোনামে ১৩ পত্রিকায়, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
এক সংবাদ একই শিরোনামে ১৩ পত্রিকায়, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
সর্বাধিক পঠিত
সন্তান বিক্রি করে জুয়েলারি ও মোবাইল কিনেছেন মা
সন্তান বিক্রি করে জুয়েলারি ও মোবাইল কিনেছেন মা
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
রাজধানীতে আবার আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল
রাজধানীতে আবার আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল
মৃত্যুর আগে ফেসবুকে লিখলেন ‘ওরা মানুষকে মানুষ মনে করে না’
মৃত্যুর আগে ফেসবুকে লিখলেন ‘ওরা মানুষকে মানুষ মনে করে না’
এক সংবাদ একই শিরোনামে ১৩ পত্রিকায়, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
এক সংবাদ একই শিরোনামে ১৩ পত্রিকায়, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ