ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। এর ফলে কি সিন্ধু নদী ও এর দুটি উপ-নদীর পানি পাকিস্তানে প্রবাহিত হওয়া বন্ধ করতে পারবে ভারত?
মঙ্গলবার ভারত-শাসিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারত এই চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেয়। পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তিনটি যুদ্ধ ও অসংখ্য উত্তেজনা সত্ত্বেও এই চুক্তি টিকে ছিল। কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো ভারত চুক্তি স্থগিত করেছে—যা পাকিস্তানের জন্য অশনি সংকেত।
সিন্ধু নদী অববাহিকার ছয়টি নদীর পানি বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে এই চুক্তি। এর অধীনে তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদী—রাভি, বিপাশা ও সতলজ—ভারতের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিমাঞ্চলীয় তিনটি নদী—সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব-এর ৮০ শতাংশ পানির অধিকার পায় পাকিস্তান।
পাকিস্তানের কৃষি ও পানির প্রায় ৮০ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশই নির্ভর করে সিন্ধু অববাহিকার পানির ওপর। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে ভারত দীর্ঘদিন ধরে চুক্তি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিল।
পানি বন্ধ করা কি সম্ভব?
ভারত যদি পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত পানি বন্ধ করতে চায়, তাহলে তাদের বিপুল পরিমাণ পানি আটকে রাখার জন্য বিশাল অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষাকালে সিন্ধু অববাহিকার শত শত কোটি ঘনমিটার পানি আটকানো ভারতের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
“ভারতের বর্তমান জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো মূলত ‘রান-অব-দ্য-রিভার’ ধরনের, যেগুলোতে বড় ধরনের জলাধারের প্রয়োজন হয় না,” বলেছেন দক্ষিণ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভারস অ্যান্ড পিপলের জলসম্পদ বিশেষজ্ঞ হিমাংশু ঠাক্কর।
তবে শুষ্ক মৌসুমে ভারত যদি পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে পাকিস্তানের কৃষি ও পানীয় জলের সংকট তৈরি হতে পারে। ‘শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে গেলে ভারতের জলাধারগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে,’ বলেছেন টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হাসান এফ খান।
পাকিস্তানের জন্য ঝুঁকি কী?
চুক্তি স্থগিতের ফলে ভারত এখন পাকিস্তানের সঙ্গে হাইড্রোলজিক্যাল ডেটা শেয়ার বন্ধ করতে পারে, যা বন্যা পূর্বাভাস ও কৃষি পরিকল্পনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘ভারত ইতোমধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে মাত্র ৪০ শতাংশ ডেটা শেয়ার করছিল,’ বলেছেন পাকিস্তানের সাবেক ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার শিরাজ মেমন।
এছাড়া, ভারত এখন পাকিস্তানকে না জানিয়েই নতুন বাঁধ বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করতে পারবে। ২০১৬ সালে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত এমনই কিছু প্রকল্প দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়েছিল, কিন্তু অগ্রগতি সীমিত রয়ে গেছে।
‘পানিবোমা’ কি সম্ভব?
একটি বড় প্রশ্ন হলো—ভারত কি পাকিস্তানের দিকে পানির স্রোত বাড়িয়ে বন্যা সৃষ্টি করতে পারবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের বাঁধগুলো পাকিস্তান সীমান্ত থেকে অনেক দূরে, তাই নিজেদের এলাকায় বন্যার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তবে হিমালয় থেকে আসা সিন্ধু নদীতে প্রচুর পলি জমে, যা হঠাৎ করে ছেড়ে দিলে পাকিস্তানের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চীনের ভূমিকা কী?
ভারতের জন্য আরও বড় চিন্তার বিষয় হলো চীন। সিন্ধু নদীর উৎপত্তি তিব্বতে এবং ব্রহ্মপুত্র নদেও চীন ভারতের ওপর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ২০১৬ সালে ভারত যখন পাকিস্তানকে হুমকি দিয়েছিল, তখন চীন ইয়ারলুং সাংপো নদীর একটি শাখা বন্ধ করে দিয়েছিল, যা পরে ব্রহ্মপুত্র নামে ভারতে প্রবেশ করে।
চীন ইতোমধ্যে তিব্বতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে, যা ভারতের জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।
চুক্তি স্থগিত করলেও ভারতের পক্ষে পানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা সহজ নয়। তবে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমিয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে চাপে ফেলা যেতে পারে। অন্যদিকে, পাকিস্তান এই সিদ্ধান্তকে ‘যুদ্ধের শামিল’ হিসেবে দেখছে এবং এর জবাব দিতে পারে।
এই সংকট শুধু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই—এটি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার পানিনীতিতে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
সূত্র: বিবিসি