কাশ্মীরের পহেলগামের পর্যটনকেন্দ্রে ভয়াবহ হামলায় কমপক্ষে ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর ভারতের নিরাপত্তা কৌশলের কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। সরকার দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে এসেছে যে চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং অঞ্চলটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে, কিন্তু মঙ্গলবারের হামলায় সেই ‘ভ্রান্ত ধারণা’ ভেঙে পড়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এ খবর জানিয়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক উত্তরাঞ্চল কমান্ড প্রধান অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডি. এস. হুদা বলেন, এই হামলার লক্ষ্যই ছিল সরকারের সেই বয়ানকে নস্যাৎ করা যে কাশ্মীর এখন শান্ত। সরকার প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছে প্রতিক্রিয়া জানানোর।
মঙ্গলবার গভীর জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি উপত্যকায় ভ্রমণে আসা হিন্দু পর্যটকদের ওপর অতর্কিতে গুলি চালায় বন্দুকধারীরা। হামলায় আহত হয়েছেন আরও ডজনখানেক মানুষ। স্থানীয় কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে ২৫ জনই হিন্দু। ঘটনার পর থেকেই পাহাড়ি উপত্যকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক পর্যটক কাশ্মীর ছাড়তে শুরু করেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এক বিবৃতিতে বলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। কেবল হামলাকারীদের নয়, যারা পেছন থেকে এই ষড়যন্ত্র করছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিহতদের মধ্যে একজন ৬০ বছর বয়সী কৌশ্তভ গুনবোতে ছিলেন, যিনি মহারাষ্ট্রের পুনে শহরের এক দোকানদার এবং পর্যটক হিসেবে কাশ্মীরে এসেছিলেন। তার ছেলে কুনাল বলেন, ওইদিন বাবাকে আমার মায়ের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। কেউ তাদের রক্ষা করার জন্য ছিল না। সন্ত্রাসীরা হাঁটছিল, নাম জিজ্ঞেস করছিল, আর নির্বিঘ্নে গুলি করছিল।
ঘটনার পর ভারত সরকার যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও সংগঠনের নাম নেয়নি, তবে নিরাপত্তা সূত্রগুলো জানায়, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’-এর মাধ্যমেই এ হামলা চালানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০১৯ সালে এক আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জনের বেশি ভারতীয় নিরাপত্তা সদস্য নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তান প্রায় যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। এবারও একই ধরনের উত্তেজনা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ভারতের সাম্প্রতিক নিরাপত্তা নীতিতে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন রাখা এবং অভ্যন্তরীণভাবে কাশ্মীরকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে কেন্দ্রীয় শাসন আরোপ করে মোদি সরকার। সরকারের দাবি ছিল, এতে উন্নয়নের পথ সুগম হবে এবং চরমপন্থা কমবে।
কিন্তু মঙ্গলবারের গণহত্যা সেই কৌশলের সীমাবদ্ধতা উন্মোচন করেছে।
ঘটনার সময় যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভারত সফরে ছিলেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, এটি একটি বিধ্বংসী সন্ত্রাসী হামলা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরেছেন এবং বুধবার সকালে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেছেন।
কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেন, হামলার পরপরই পর্যটকদের যেভাবে উপত্যকা ছেড়ে যেতে দেখা গেছে, তা হৃদয়বিদারক। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা তাদের উদ্বেগ বুঝতে পারি।
হামলার পর বুধবার কাশ্মীরের বহু অংশে হরতাল পালিত হয়। দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এলাকাজুড়ে হেলিকপ্টার থেকে নজরদারি চালায় নিরাপত্তা বাহিনী।
হামলার দায় এড়াতে পাকিস্তান শুরু থেকেই বিষয়টিকে ‘ঘরোয়া চরমপন্থার’ ফল হিসেবে বর্ণনা করেছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করি না’।
তবে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের এক সাম্প্রতিক বক্তব্য, যেখানে তিনি কাশ্মীরকে ‘আমাদের শিরার রক্তপ্রবাহ’ আখ্যা দেন, সেটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ফের আলোচনায় এসেছে এবং উত্তেজনা আরও উসকে দিয়েছে।
কাশ্মীর নিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের ‘স্বাভাবিকতা’র বয়ান মঙ্গলবারের ঘটনাতেই নষ্ট হয়ে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা জোরদার করেছে বটে, তবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রশ্নে আরও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে—বিশেষ করে যখন অঞ্চলটির হিন্দু সংখ্যালঘুরা আবারও অনিরাপদ বোধ করছেন। এই হামলা কেবল নিরাপত্তার ব্যর্থতাই নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশলেরও একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মোদি সরকারের সামনে।