X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

‘রেয়ার আর্থ’ খনিজ রফতানিতে চীনা নিয়ন্ত্রণে বিপাকে যুক্তরাষ্ট্র

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:০৬আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:০৬

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ যখন নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে, তখন শুধু পাল্টাপাল্টি শুল্কই নয়, আরও কৌশলী উপায়ে জবাব দিচ্ছে বেইজিং। এবার তারা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজ রেয়ার আর্থ ও চুম্বক রফতানিতে। যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কী ভয়ানকভাবে চীননির্ভর যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাত। এই অবস্থার মোকাবিলায় নিজস্ব খনিজ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই রেয়ার আর্থ খনিজ এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

কী এই রেয়ার আর্থ, কী কাজে লাগে?

‘রেয়ার আর্থ’ বলতে বোঝানো হয় ১৭টি রাসায়নিক মৌল, যেগুলো উচ্চ প্রযুক্তির পণ্যে অত্যাবশ্যক। যেমন, নিয়োডিমিয়াম দিয়ে তৈরি চুম্বক ব্যবহৃত হয় কম্পিউটার হার্ড ড্রাইভ, বৈদ্যুতিক গাড়ির মোটর, জেট ইঞ্জিন ও স্পিকার তৈরিতে। ইউরোপিয়াম ও ইট্রিয়াম ব্যবহৃত হয় টেলিভিশন ও কম্পিউটার স্ক্রিনে, রঙ প্রদর্শনের জন্য।

জিঞ্জার ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক থমাস ক্রুয়েমার বলেন, যেকোনও বৈদ্যুতিক যন্ত্র, যা চালু বা বন্ধ করা যায়, তাতে রেয়ার আর্থ লাগে।

এছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞানেও এসব মৌল অপরিহার্য—লেজার সার্জারি থেকে এমআরআই পর্যন্ত। আর প্রতিরক্ষা খাতে তো বটেই।

রেয়ার আর্থ রফতানিকারক দেশগুলোর অবস্থান

চীনের নিয়ন্ত্রণ কোথায়?

চীন বর্তমানে বৈশ্বিক রেয়ার আর্থ উত্তোলনের ৬১ শতাংশ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ৯২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এর মানে, খনি থেকে উত্তোলন থেকে চূড়ান্ত পণ্য তৈরির পুরো চেইনটাই চীনের হাতে।

বিষয়টি শুধু খনিজ তোলার নয়—তাতে থাকা তেজস্ক্রিয় উপাদানগুলোর নিরাপদ নিষ্কাশনও জটিল ও ব্যয়বহুল। তাই ইউরোপসহ অনেক দেশই এসব খনিজ উত্তোলনে আগ্রহী নয়।

ক্রুয়েমার বলেছেন, ইউরোপে এখন পর্যন্ত স্থায়ী কোনও নিষ্কাশন কেন্দ্র নেই।

চীনের এই আধিপত্য এসেছে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে। ১৯৯২ সালে চীনের নেতা দেং শিয়াওপিং বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যের কাছে তেল আছে, চীনের আছে রেয়ার আর্থ।

চীনের নতুন রফতানি নিয়ন্ত্রণ কীভাবে কাজ করছে?

এই মাসের শুরুতে চীন সাতটি ‘হেভি রেয়ার আর্থ’ খনিজের রফতানি নিয়ন্ত্রণে নতুন নির্দেশনা জারি করে। এসব খনিজ তুলনামূলকভাবে বেশি দুষ্প্রাপ্য এবং প্রতিরক্ষা শিল্পে অপরিহার্য।

এখন থেকে এসব রফতানির জন্য চীন সরকারের বিশেষ লাইসেন্স লাগবে। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি অনুযায়ী, ‘দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য’ পণ্যের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার রয়েছে চীনের।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস) বলছে, এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলেছে। কারণ, চীনের বাইরে হেভি রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াজাতকরণের পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি কোথায়?

২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার রেয়ার আর্থ প্রয়োজনের ৭০ শতাংশই চীন থেকে আমদানি করেছে। ফলে চীনের নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে আঘাত হানবে।

এই খনিজ ছাড়া তৈরি করা যায় না এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র বা প্রিডেটর ড্রোনের মতো আধুনিক অস্ত্র।

ক্রুয়েমার বলেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পে গভীর প্রভাব ফেলবে।

শুধু প্রতিরক্ষা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে ট্রাম্পের ট্যারিফ নির্ভর পুনর্জাগরিত উৎপাদন খাতও। বিশেষত প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে উৎপাদনে বিলম্ব ও সরবরাহ সংকট দেখা দিতে পারে।

বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক গ্যাভিন হার্পার বলেন, মূল উপকরণের মূল্য বাড়বে, ফলে মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে অস্ত্র পর্যন্ত—সবকিছুর খরচ বাড়বে।

যুক্তরাষ্ট্র কি নিজের খনিজ তুলতে পারবে না?

যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে একটি রেয়ার আর্থ খনি চালু আছে। কিন্তু তারা হেভি রেয়ার আর্থ পৃথক করতে পারে না, এজন্য কাঁচামাল পাঠাতে হয় চীনে।

১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই ছিল সবচেয়ে বড় উৎপাদক। কিন্তু চীনের সস্তা উৎপাদন ও পরিবেশের কম নিয়ন্ত্রণের কারণে তারা বাজার থেকে ছিটকে পড়ে।

এই প্রেক্ষাপটেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেন বা গ্রীনল্যান্ডের সঙ্গে খনিজ চুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন। গ্রীনল্যান্ডে রয়েছে রেয়ার আর্থের বিশাল ভাণ্ডার। তবে ট্রাম্পের আগ্রাসী অবস্থান এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে জটিল করে তুলছে।

ড. হার্পার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করেছে, আবার যেসব দেশ বিকল্প সরবরাহ দিতে পারত, তাদেরও দূরে ঠেলে দিয়েছে।

চীন যখন একের পর এক কৌশলী চাল দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র চাপে পড়ছে কাঁচামালের সরবরাহ নিয়ে। বাণিজ্য যুদ্ধের নতুন এই ধাপে ‘খনিজ যুদ্ধ’ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের ভাষায়, ‘আধুনিক প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা এবং পরিকাঠামোর জন্য রেয়ার আর্থ অপরিহার্য। এই খাতে বিদেশনির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।’

এখন দেখার বিষয়, চীনের হাতে থাকা এই খনিজ কার্ডের মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র কী কৌশল নেয়—নাকি কেবল ট্যারিফ দিয়ে এই যুদ্ধ জয় করার চেষ্টা চালিয়ে যায়।

সূত্র: বিবিসি

/এএ/
সম্পর্কিত
পাকিস্তানে কেএফসি’র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, একজন নিহত
ইউক্রেন শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসবে যুক্তরাষ্ট্র : ট্রাম্প
অমীমাংসিত ইস্যুগুলোতে নীরব পাকিস্তান
সর্বশেষ খবর
এক সংবাদ একই শিরোনামে ১৩ পত্রিকায়, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
এক সংবাদ একই শিরোনামে ১৩ পত্রিকায়, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
নীলফামারীতে দুদকের গণশুনানি রবিবার 
নীলফামারীতে দুদকের গণশুনানি রবিবার 
চট্টগ্রামে নগরীর নালায় নিখোঁজ শিশুর লাশ উদ্ধার
চট্টগ্রামে নগরীর নালায় নিখোঁজ শিশুর লাশ উদ্ধার
সর্বাধিক পঠিত
সন্তান বিক্রি করে জুয়েলারি ও মোবাইল কিনেছেন মা
সন্তান বিক্রি করে জুয়েলারি ও মোবাইল কিনেছেন মা
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
রাজধানীতে আবার আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল
রাজধানীতে আবার আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল
মৃত্যুর আগে ফেসবুকে লিখলেন ‘ওরা মানুষকে মানুষ মনে করে না’
মৃত্যুর আগে ফেসবুকে লিখলেন ‘ওরা মানুষকে মানুষ মনে করে না’
ভারতের সংখ্যালঘু ইস্যুতে বাংলাদেশের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বললো দিল্লি
ভারতের সংখ্যালঘু ইস্যুতে বাংলাদেশের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বললো দিল্লি