ইউক্রেনের যুদ্ধের এক হাজারতম দিনে রাশিয়ার গভীরে লক্ষ্যবস্তুতে হামলার জন্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল ওয়াশিংটন। আর এরই সুযোগ নিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। চলতি সপ্তাহান্তের আগ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আমেরিকার অস্ত্র ব্যবহার করে এই ধরণের হামলার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছিলেন। তার ভয় ছিল, এই সিদ্ধান্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্ররোচনা দিতে পারে।
এর প্রতিক্রিয়ায়, একই দিন রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি নতুন পারমাণবিক মতবাদ ঘোষণা করেছিল, যেটির ইঙ্গিত দুই মাস আগেই দিয়েছিল দেশটি। তবে রুশ কর্তৃপক্ষ এদিন প্রথমবারের মতো ঘোষণা করেছিল, রাশিয়ার অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে শুধু এমন একটি আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই নয়, বরং দেশটির সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য একটি ‘গুরুত্বর হুমকি’ তৈরি করেছে এমন হামলার ক্ষেত্রেও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হবে’—কুরস্ক অঞ্চলে আমেরিকার তৈরি দুরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে রুশ অস্ত্র অস্ত্রাগারে আঘাত হানার মতো একটি পরিস্থিতি কথা বোঝানো হয়েছে।
তবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাশিয়ার নির্দেশিকাগুলোতে আরও একটি বিষয়ের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল: প্রথমবারের মতো দেশটি এমন একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার ঘোষণা করেছে যেটি শুধু প্রচলিত অস্ত্রের অধিকারী, তবে সেটিকে একটি পারমাণবিক শক্তি সমর্থন করে। এমন নীতি গ্রহণের সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মনে পাঁচটি প্রধান পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের তিনটি; যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কথা ছিল বলে মনে হয়, যারা ইউক্রেনকে সমর্থ করে।
তবুও রাশিয়ার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা কেবল একটি হাই তোলার মতই নগণ্য ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা এই মতবাদটিকে পারমাণবিক হুমকির ফাঁকা বুলি বলে উড়িয়ে দিয়ে ইউক্রেনকে মার্কিন তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়ায় হামলার অনুমতি দেন। পারমাণবিক হামলার আশংকার পরিবর্তে শহরটি সেদিন দেশের ট্রেজারি সেক্রেটারি হিসেবে কে প্রাধান্য পাবেন বরং তা নিয়েই জল্পনা-কল্পনায় মেতে ছিল।
ইউক্রেন যুদ্ধ বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে: এটি কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, লণ্ডভণ্ড করেছে লাখ লাখ মানুষের জীবন, এটি পুরো ইউরোপকে নাড়িয়ে দিয়েছে এবং রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার শত্রুতাকে আরও গভীর করেছে। তবে এই যুদ্ধ ওয়াশিংটন ও পুরো বিশ্বকে আবারও চূড়ান্ত দর কষাকষির বিষয় হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্রের পুনর্নবীকরণের জন্য ঠেলে দিয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী নয়টি দেশের একটি এখন সেই বোতামটি চাপতে পারে—এমন ধারণাটি এখন জোরদার হয়েছে। এরমধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দশম হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে ইরান।
হার্ভার্ডের অধ্যাপক ম্যাথিউ বুন কয়েক দশক ধরে পারমাণবিক ঝুঁকির ওপর নজর রাখছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটি একটি সংকেতমূলক অনুশীলন যেটি ইউরোপের শ্রোতাদের ভয় দেখানোর এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থন বন্ধ করানোর চেষ্টা করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রুশ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রকৃত স্বল্পমেয়াদী সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়নি। তবে পারমাণবিক যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনা সম্ভবত কিছুটা বেড়েছে। কেননা, রাশিয়ার গভীরে হামলাকে সমর্থন করার মার্কিন ইচ্ছা, পুতিনের পশ্চিমের প্রতি ঘৃণা ও ভয়কে আরও শক্তিশালী করছে এবং সম্ভবত এটি রুশ প্রতিক্রিয়াগুলোকে উস্কে দেবে যা পশ্চিমাদের মধ্যে ভয় ও রাশিয়ার প্রতি ঘৃণা বাড়িয়ে দেবে।’
ইউক্রেনীয়দের আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেমস বা (এটিএসিএমএস) নামে পরিচিত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত বাইডেন নিয়েছেন, তা মার্কিন নীতিতে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় নয় সপ্তাহের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। নির্বাচনি প্রচারণার সময় তিনি ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সমর্থন সীমিত করার এবং ক্ষমতায় এলে ’২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
নতুন পারমাণবিক মতবাদটি পুতিনের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রাগারকে এমন কিছুতে পরিণত করার সাম্প্রতিকতম প্রচেষ্টার মধ্যে একটি, যা বিশ্ব আবারও ভয় পেতে পারে এবং তাকে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করতে পারে যা তার ‘গ্যাস- যুদ্ধ--অর্থনীতি এখন্ও দিতে পারেনি।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এক বিবৃতিতে বাইডেন প্রশাসন নতুন মতবাদের নিন্দা করেছে। তবে এ নিয়ে কোনও আশংকা প্রকাশ করেনি। ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, রাশিয়ার পারমাণবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনও পরিবর্তন হয়নি। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা স্তরে পরিবর্তনেরও কোনও প্রয়োজন নেই। ওই বিবৃতির অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল এই যে, এসব ফাঁকা বুলি। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেওয়ার জন্য পুতিন মনগড়া একটি নতুন যুক্তি তৈরির চেষ্টা করছেন। এমনকি, পুতিনের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কোনও পরিবর্তন হয়নি বলেও স্পষ্ট করা হয়।
একজন এমআইটি অধ্যাপক ও পরমাণু বিশেষজ্ঞ ভিপিন নারাং বলেছেন, ‘তিনি যে পরিসরেই এটি তৈরি করার চেষ্টা করুন না কেন, যে কোনও স্থানে, যে কোনও সময়, যে কোনও পরিমাপে একটি অ-কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের বিষয়ে পুতিনের সিদ্ধান্ত এখনও গুরুতর পরিণতির মুখোমুখি হবে, যেমনটি প্রেসিডেন্ট বাইডেন বারবার উল্লেখ করেছেন।’
সম্প্রতি পেন্টাগনে দুই বছরের অ্যাসাইনমেন্ট থেকে ফিরেছেন নারাং। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন, বৃহত্তরভাবে শ্রেণীবদ্ধ ‘পারমাণবিক কর্মসংস্থান নির্দেশিকা’ নিয়ে কাজ করেছিলেন। এই নির্দেশিকা চীনের ক্রমবর্ধমান অস্ত্রাগার ও রাশিয়ার সঙ্গে এর অংশীদারিত্বের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়।
নারাং উল্লেখ করেন, ‘পুতিনকে এখনও যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া এবং সামরিক বৃদ্ধি ব্যবস্থাপনার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এমনকি রুশ মতবাদের এই সংশোধনগুলো পর্যালোচনা করার পর, আমি এখনও খুব আত্মবিশ্বাসী যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর প্রচলিত ও পারমাণবিক দৃষ্টিভঙ্গি রুশ পারমাণবিক কর্মসংস্থানকে রোধ করতে পারে এবং ভুল করলে প্রতিরোধ পুনরুদ্ধারও করতে পারে।’
তবে সেই ভুলের সম্ভাবনা কম বলে মনে হচ্ছে: সমগ্র যুদ্ধে পুতিন যুদ্ধ থেকে দূরে রাখতে চান ন্যাটোভুক্ত এমন দেশগুলোর ওপর যে কোনও প্রকাশ্য আক্রমণ শুরুর বিষয়ে সতর্ক ছিলেন। পুতিন আসলেই একটি পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে—অনেক সময়ই যুক্তরাষ্ট্রকে এমন ভয় পেতে দেখা গেছে। বিশেষ করে ২০২২ সালের অক্টোবরে যখন আমেরিকার গোয়েন্দা কর্মকর্তারা রুশ জেনারেলদের মধ্যকার একটি কথোপকথন ট্রাক করেছিলেন। তখন তারা আশংকা করছিলেন, পুতিন একটি ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি বা অন্য লক্ষ্যবস্তুতে যুদ্ধক্ষেত্রের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবেন।
তখন নিউ ইয়র্কের একটি তহবিল সংগ্রহকারী অনুষ্ঠানে উপস্থিতদের উদ্দেশে বাইডেন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর থেকে যে কোনও সময়ের চেয়ে একটি পারমাণবিক বিনিময়ের কাছাকাছি ছিল, যা কক্ষের কিছু ব্যক্তিদের আতঙ্কিত করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। নারাং যেমনটি উল্লেখ করেছেন, ‘একটি পারমাণবিক ব্যাপ্তি শুধু ফাঁকা বুলি দিয়ে নির্ধারিত হয় না, বরং প্রতিরোধের ভারসাম্য ও খুঁটির মাধ্যমে নির্ধারিত হয় এবং ঘোষণামূলক মতবাদের পরিবর্তনগুলো যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যকার প্রতিরোধের ভারসাম্যকে মোটেই পরিবর্তিত করে না।’
তবে এটি সেই বিশ্ব নয়, যে বিশ্ব ২০২০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমা নেতারা কল্পনা করেছিলেন। প্রচণ্ড গতিতে রুশ ও আমেরিকান অস্ত্র তুলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী যুগ শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিনিময়ে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের কাছে হাজার হাজার পারমাণবিক অস্ত্র ফিরিয়ে দেয় ইউক্রেন। অনেক ইউক্রেনীয় আজও সেই দিনের জন্য আফসোস করেন। যুদ্ধাস্ত্রগুলো পারমাণবিক শক্তির জন্য জ্বালানীর সঙ্গে মিশ্রিত করে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল এবং সেগুলো বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বাড়ি আলোকিত ও উষ্ণ করে চলেছে।
মাত্র ১৫ বছর আগে কথা, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন। যদিও সেই মুহূর্তটি তিনি তার শাসনামলে দেখে যেতে পারেননি। তবে পরে আমেরিকান কৌশলে সেগুলোর গুরুত্ব কমিয়ে দেন ওবামা।
সে সব দিন এখন অতীত। পুতিন তার ক্ষমতা প্রদর্শনের অংশ হিসেবে বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেছেন। শিগগরিই সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে কোনও সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হবেন না তিনি। কেননা, তার কাছে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে সক্ষম এমন আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। যদিও এই জাতীয় কৌশলগত অস্ত্রের সংখ্যা সীমিত করে ওয়াশিংটন ও মস্কো একটি চুক্তি করেছিল যেটি ‘নতুন শুরু’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। তবে চুক্তিটির মেয়াদ মাত্র ১৫ মাসের মধ্যেই শেষ হতে চলেছে। এর পর এটি আবারও প্রতিস্থাপিত করা হবে এসমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
নতুন রাশিয়া-চীন অংশীদারিত্ব ও দেশগুলো তাদের অস্ত্রগুলো ব্যবহার করতে পারে এমন আশংকার মধ্যেই আমেরিকার অস্ত্রাগার প্রসারিত করার প্রয়োজন নিয়ে ইতোমধ্যে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান তোড়জোর শুরু করেছেন।
পুতিনের সংশোধিত কৌশলের মূল বার্তাটি এই নয় যে, পারমাণবিক অস্ত্র আবারও ফিরে এসেছে, বরং সেগুলো আসলে সবসময় বিদ্যমান ছিল।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস