পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগের দাবিতে মানুষের অভ্যুত্থান চলবে, এমনই মঙ্গলবার নবান্ন অভিযানে এমনই হুঁশিয়ারি দিলো পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজ। তাদের সাফ কথা, ‘আজকের আন্দোলনই শেষ নয়, আরও ভয়ংকর গণআন্দোলন করে খুব শিগগিরই মুখ্যমন্ত্রীকে পদচ্যুত করবে পশ্চিমবাংলার সাধারণ মানুষ। সেটির ট্রেলার আজ দেখিয়ে দিলেন তারা।’
মঙ্গলবার নবান্ন অভিযানে মহাত্মা গান্ধী রোডে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার সময় পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজের প্রধান সমন্বয়ক সায়ন লাহিড়ী যুগশঙ্খকে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন ঠেকাতে উচুঁ ব্যারিকেড করা হয়েছিল সর্বত্র। কিন্তু ছাত্র-যুবরা এই বেড়া টপকে এগিয়ে গেছে। সেই মুহূর্তে রাসায়ানিক মিশানো টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে আমাদের ঠেকানোর চেষ্টা করেও সফল হয়নি পুলিশ। এখন পর্যন্ত কত আহত হয়েছেন, কতজন গ্রেফতার হয়েছেন তা বলতে পারব না। এত কিছুর পরেও ছাত্র-জনতাকে রোখা যায়নি, তারা নবান্নের ৫০ মিটারের মধ্যে পৌঁছে প্রতিবাদ করেছেন। তারা বলেছেন, দফা এক, দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ! যা এর আগে কোনও রাজনৈতিক দল পারেনি।’
সোমবার মধ্যরাতে ছাত্রসমাজের চারজনকে পুলিশের তুলে নেওয়া নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সায়ন বলেন, ‘তাদেরকে তো তুলে নেওয়া হবেই। যারা এই আওয়াজ তোলার সাহস করেছে তাদের এই শোষক, এই ধর্ষকদের প্রশয়কারীরা আটক রাখবেই বলেই এই ঘটনা রাতের অন্ধকারে ঘটিয়েছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী জেনে রাখুন কোনও জেল আমাদের এই প্রতিবাদকে স্তব্ধ করতে পারবে না। এই আন্দোলন মুখ্যমন্ত্রীকে গদিচ্যুত করা পর্যন্ত চলবে। কোনও ব্যক্তি নয়, তার অহংকারকে বাংলার মানুষ যতক্ষণ না ভাঙতে পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।’
সায়ন আরও বলেন, ‘বাংলা বনধ নিয়ে এখনই কিছু বলতে পারব না। আমরা মাঠ ছাড়ছি না। এখন আমরা মধ্য কলকাতা অবরুদ্ধ করব। দফায় দফায় প্রতিদিন এই আন্দোলন চলবে রাজ্যের সর্বত্র, যতক্ষণ না মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। তাকে সোমবার পর্যন্ত বাংলার মানুষ আলটিমেটাম দিয়েছিলেন পদত্যাগ করার, উনি মানেননি। এবার জনগণ তাকে পদত্যাগ করানোর দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন। যেখানে সেখানে সাধারণ মানুষ রাস্তায় বসে পড়বেন শান্তিপূর্ণভাবেই। আজ এত মানুষের পদধ্বনী তার নবান্নের চৌদ্দতলা কাঁপিয়ে দিয়েছে। আমি আশাবাদী উনি এই জনকম্পন টের পেয়েছেন।’
ছাত্রসমাজের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা করা হচ্ছিল, তার জবাবও আজকে সাধারণ মানুষ দিয়েছেন বলে দাবি সায়নের। তিনি বলেন, ‘সবাইকে দেখিয়ে দিলো, আজ কারা সন্ত্রাস করে আন্দোলন স্তব্ধ করার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে সময় শহীদ ভগৎ সিংকেও তৎকালীন শাসকরা সন্ত্রাসী বলেছিল। আজ আমাদের বলা হচ্ছে। কোনও রাজনৈতিক পতাকা ছাড়া জাতীয় পতাকা নিয়ে লাখো মানুষ আজ রাস্তায় নেমেছিলেন। তারা একটা ইট-পাথর পর্যন্ত ছুড়েননি। অথচ, তৃণমূলের গুণ্ডারা বাড়ির ছাদ থেকে নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর ইট-পাথর ছুড়লো। যা সবাই টিভির মাধ্যমে পরিষ্কার দেখলো।’
বামদের কটাক্ষ করে সায়ন বলেন, ‘ওদের নিয়ে কী বলব? বামেরা তৃণমূলের রসদ যোগানোর মেশিন। তাই সাধারণ মানুষের এই আন্দোলনে তারা ছিলেন না। সাধরণ মানুষ এটা বুঝতে পেরে আজ রাস্তায় নামলো। বামদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মানুষ আজ রাস্তায় নামলেন। বামদের কোনও যৌক্তিকতা নেই। তারা ধান্ধাবাজির জন্য ‘হোক কলরব’র মতো আন্দোলন করে। আমরা ভুল করলে মানুষ বিচার করবে, শাস্তি দেব। ভালোবাসলে পাশে এসে দাঁড়াবে। এই আন্দোলন আজ শুরু হয়ে গেলো।’
সায়নের বক্তব্যের মেজাজ আজ পাওয়া গেছে সর্বত্র। এক আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট জানালেন, ‘আজ পুলিশ গুলি করুক। যা করুক বুক পেতে মেনে নেবো। গুলি করলেও পিছু হটব না।’
অপর এক আন্দোলনকারী বলেন, ‘আজ কোনও বাধা মানবো না। মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতেই হবে। কোনও কথা শুনবো না।’
মঙ্গলবারের নবান্ন অভিযানে হাওড়া ময়দানের সামনে দেখা পাওয়া গেলো বাবা-মায়ের হাত ধরে আসা এক স্কুল শিক্ষার্থীর। দৃঢ় কণ্ঠে নিজের বক্তব্য পেশ করে এই ছোট্ট নাবালিকা প্রতিবাদী আন্দোলন ছেড়ে যেতে চায়নি। পুলিশ তাকে বোঝাতে এলে, পুলিশের সামনে সে সাফ বলে, ‘আমি যাবো না, মা-বাবার সঙ্গেই থাকব...। মারুক... আমায় মারুক।’
ইতোমধ্যে এক নারীকে আচমকাই দেখা যায় যে, তিনি একলাই হেঁটে আসছেন পুলিশের ব্যারিকেডের দিকে। এরপর তিনি পুলিশের সামনে আঙুল উঁচিয়ে বলতে থাকেন, ‘আমি ধর্ষিতা হতে চাই না। বাংলার মা-বোনেরা ধর্ষিতা হতে চান না। আমায় গুলি করে মেরে ফেলুন।’
ওই নারীর সামনে কার্যত অস্বস্তিতে পড়ে যান উপস্থিত পুলিশকর্মীরা। এই সময় আন্দোলনকারীরাও বলতে থাকেন, ‘আমরা ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। যারাই রক্ষক তারাই ভক্ষক। এই মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে।’
নবান্ন অভিযানে এদিন এমজি রোডে কামদুনির বধূ তথা বাংলার প্রতিবাদের পরিচিত মুখ টুম্পা কয়ালকে দেখা গেছে। সেখানে একটি বহুতল ভবন থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর পাথর মারা হচ্ছিলো বলে অভিযোগ। বাড়িটির দিকে এগিয়ে যান টুম্পাসহ আন্দোলনকারীরা। তারা বলতে থাকেন, ‘তৃণমূলের গুণ্ডারা তাদের ওপর পাথর ছুঁড়ছেন।’
এ নিয়ে প্রবল বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। এ সময় টুম্পা কয়ালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি পুলিশকে বলেন, ‘আমায় গুলি করুন। জেলে নিয়ে যান। আর কত বাংলার মা-বোন ধর্ষণ হবেন।’
এদিকে, সংগ্রামী ঐক্যমঞ্চের সদস্যরা হাওড়ায় পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। সামনে তখন চলছে জলকামান। আন্দোলনকারীদের দমাতে দফায় দফায় টিয়ার গ্যাসের সেল নিক্ষেপ করছে পুলিশ। তার মধ্যে রাস্তাতেই বসে পড়েন তারা। পুলিশের তরফ থেকে তাদের ১০ মিনিটের সময়সীমা দেওয়া হয়। বলা হয়, অবস্থান না তুললে কড়া পদক্ষেপ করা হবে। এই পরিস্থিতিতে ভাস্কর ঘোষ বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপরে বলপ্রয়োগ করতে পারবে না, সেটা সুপ্রিম কোর্ট বলেছে। পুলিশের যে কর্মকর্তা বলছেন, তিনি সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির ওপরের পদমর্যাদার হলে তিনি পারবেন।’
কথা বলার মাঝেই আচমকা আন্দোলনকারীদের দিকে উড়ে আসে পাথর। কিন্তু কারা পাথর ছুড়ছেন? ভাস্কর বললেন, ‘পুলিশই লোক রেখেছে ওখানে। পুলিশের লোক তারা। শুধু মাথায় রাখুন, সুপ্রিম কোর্টে আমাদের আইনজীবীরা বসে রয়েছেন। সব ছবিতে ধরা পড়ছে। আদালত অবমাননার মামলাটা হবে। যতক্ষণ না দাবি আদায় হচ্ছে, আন্দোলন চলবে।’ তার বিস্ফোরক উক্তি, ‘এই যে সিস্টেমটা তৈরি করেছে, ধর্ষক-খুনি হলেও নীল-সাদা আঁচলের তলায় তোমাকে সুরক্ষা দেওয়া হবে, এই ব্যবস্থার বদল হবে।’