নির্বাচনী বন্ডে কোটি টাকা না নিলেও সর্বহারার পার্টি বলে ঘোষিত সিপিএম কোটিপতি প্রার্থী কিন্তু রয়েছেন। এমন তথ্যই চব্বিশের লোকসভা সিপিএমের প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামায় উঠে এসেছে। এই তালিকায় খোদ সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন যাদবপুরের তরুণ তুর্কি ছাত্র সৃজন ভট্টাচার্যের নামও। দলের হোলটাইমার হয়েও কোটিপতি তারা, যা নিয়ে বাংলার রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
এবার মুর্শিদাবাদ লোকসভা আসনের সিপিএম প্রার্থী ও দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি দলের সর্বক্ষণের কর্মী। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৬৮ লক্ষ ৫১ হাজার টাকা। হলফনামা অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সালে সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের মোট আয় ৪ লক্ষ ১৫ হাজার ৫৮০ টাকা। আর তার স্ত্রীর আয় ১৯ লক্ষ ৮ হাজার ৬১০ টাকা, যা তার আয়ের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি। মনোনয়ন পেশের সময় মহম্মদ সেলিমের হাতে নগদ ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা আর ৬ হাজার ৫০০ টাকা ছিল তার স্ত্রীর হাতে।
হলফনামা অনুযায়ী সিপিএম প্রার্থীর ব্যাংক ব্যালেন্স ৩২ হাজার ৬২৮ টাকা। স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে জমা আছে ১৬ লক্ষ ১৩ হাজার ৪৪৩ টাকা। শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ডসহ বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পে সেলিমের সঞ্চয় ৪৭ লক্ষ ৪৯ হাজার ৮৫০ টাকা, যেখানে স্ত্রীর সঞ্চয়ের অঙ্ক ২৯ লক্ষ ৮৩ হাজার ৮১৩ টাকা। সিপিএম প্রার্থীর জীবন বিমার পরিমাণ ৪২ হাজার ৪০৭ টাকা। স্ত্রীর নামে পলিসি আছে ৩ লক্ষ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকার।
তবে সিপিএম প্রার্থীর কোনও গাড়ি না থাকলেও তার স্ত্রীর নামে গাড়ি আছে ২টি। যার মূল্য ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। মহম্মদ সেলিমের নামে সোনা আছে ৭ হাজার ৫০০ টাকার। আর স্ত্রীর কাছে থাকা গয়নার মূল্য ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে সিপিএম প্রার্থীর মোট অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ লক্ষ ৩৪ হাজার ৮৮৫ টাকা, যেখানে তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৬৫ লক্ষ ৯৮ হাজার ৫৫৬ টাকা।
হলফনামায় স্থাবর সম্পত্তিরও হিসেব দিয়েছেন মহম্মদ সেলিম। সিপিএম এই প্রার্থী জানিয়েছেন, তিনি ও তার স্ত্রীর নামে কোনও কৃষি বা অকৃষি জমি নেই। তবে সল্টলেক ও শিলিগুড়িতে স্ত্রীর নামে শুধু ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে। সেগুলোর বর্তমান বাজার মূল্য ২৬ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে সিপিএম প্রার্থীর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৪৮ লক্ষ ৩৪ হাজার ৮৮৫ টাকা। প্রার্থীর স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে ৯২ লক্ষ ৬৮ হাজার ৫৫৬ টাকার। সব মিলিয়ে দম্পতির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মোট পরিমাণ ১ কোটি ৪১ লক্ষ ৩ হাজার ৪৪১ টাকা।
নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, অপর দলের সর্বক্ষণের কর্মী যাদবপুর লোকসভায় সিপিএম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচায়ের নিজের কোনও গাড়ি এবং সোনাদানা না থাকলেও তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১ কোটি ৭১ হাজার ৮০ টাকা। নির্বাচনী হলফনামা জমা দেওয়ার সময় সৃজনের হাতে নগদ ২ হাজার ৫০০ টাকা ছিল। এছাড়া, বেশ কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার। এর মধ্যে যাদবপুর ব্রাঞ্চের স্টেট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তার ৮ লক্ষ ৫ হাজার টাকা রয়েছে। কসবার ইন্ডিয়া ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে রয়েছে ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৫৪৬ টাকা। বালিগঞ্জের স্টেট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে আরও ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৫৫৯ টাকা।
অন্যদিকে, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকে তার আরও একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তবে সেটিতে কোনও টাকা নেই। নির্বাচনী হলফনামায় একাধিক জায়গায় সৃজনের বিনিয়োগ থাকার বিষয়েও বলা হয়েছে। এছাড়া, চাষযোগ্য কোনও জমি না থাকলেও দুটি বাড়ি রয়েছে সৃজনের। এর মধ্যে, একটি ফ্ল্যাট রয়েছে কসবায়। তার আনুমানিক মূল্য ১৫ লক্ষ টাকা। দ্বিতীয় বাড়িটি রয়েছে শান্তি নিকেতনে। ওই বাড়ির বাজার দর প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা।
সৃজনের সম্পত্তির কথা বিবরণ পাওয়া গেলেও তার স্ত্রীর নামে খুব বেশি সম্পত্তি অবশ্য নেই। নির্বাচনী হলফনামা জমা দেওয়ার সময় তার স্ত্রীর হাতে নগদ ৬ হাজার টাকা ছিল। তারও বেশ কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার মধ্যে ৫৬ হাজার ৮৪৬ টাকা রয়েছে চৌরঙ্গী ব্রাঞ্চের স্টেট ব্যাংকে। আর পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্ধমান শাখায় রয়েছে ১৭ হাজার ৪০৫ টাকা।
এছাড়া, পিএফএফ অ্যাকাউন্টও রয়েছে তার। এতে ৩২ হাজার ৬৩৫ টাকা আছে। এনএসসি এসি-সিআইএফ-এ রয়েছে ৮০ হাজার টাকা। রয়েছে ৩০ গ্রাম সোনাও। সব মিলিয়ে সৃজনের স্ত্রীর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৪ লক্ষ ১৭ হাজার ৮৮৬ টাকা।
এখন পর্যন্ত সিপিএম নামক সর্বহারা দলের সবচেয়ে ধনী প্রার্থী জলপাইগুড়ির প্রার্থী দেবরাজ বর্মন। এই কেন্দ্রের ৭ জন প্রার্থীর মধ্যেও সবচেয়ে ধনী তিনি। হলফনামায় দেখা যায়, তার সম্পত্তির পরিমাণ ৩ কোটি ৮৯ লক্ষ ৮৯ হাজার ৪৬৮ টাকা। ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বর্মনের ২ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য পলিসি, আমানত এবং ১ কোটি টাকারও বেশি গয়না রয়েছে তার৷
বর্মন আরও জানিয়েছেন, বর্মনের স্ত্রী জলপাইগুড়ির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। ২০২২-২৩ সালে তার মোট আয় ছিল ৬ লক্ষ টাকা, যেখানে তার স্ত্রীর আয় ছিল ৪ লাখ। বর্তমানে দেবরাজ বর্মনের হাতে টাকা রয়েছে নগদ ৩৫ হাজার টাকা। হলফনামা অনুযায়ী, তার ৪৩ লক্ষ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে তার আয় ছিল ৬ লক্ষ ১৪ হাজার ৭৬০ টাকা। আর তার বাবা দীনেশচন্দ্র বর্মনের বার্ষিক আয় ছিল ১৪ লক্ষ ৩০ হাজার ২৫০ টাকা। বর্তমানে দেবরাজের বাবার অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণই দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৬৩ লক্ষ ৫৯ হাজার ৩৫১ টাকা। আর স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ৬০ লক্ষ টাকার।
সিপিএমের আরেক পরিচিত যুব মুখ এবারের নির্বাচনের তমলুক লোকসভার প্রার্থী সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। কোটিপতি না হলেও তার দশলাখি গাড়িতে চড়েন তিনি। তার হলফনামায় এমন তথ্যই জানানো হয়েছে।
নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গত অর্থ বছরে ৪ লক্ষ ৭১ হাজার ১৩০ টাকা আয় করেছেন। আর ২০২২-২৩ অর্থ বছরে তার আয় ছিল ৪ লক্ষ ৫৮ হাজার ৯৮০ টাকা। তার হাতে এই মুহূর্তে নগদ ১০ হাজার টাকা আছে। সায়নের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং বিনিয়োগ মিলিয়ে ৯ লক্ষ ৮৮ হাজার ১১০ টাকা রয়েছে। দুটি গাড়ির মালিকও তিনি। একটির মূল্য ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা এবং অপরটির ১০ লক্ষ ৫৪ হাজার ৯০১ টাকা। নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ২১ লক্ষ ৭৩ হাজার ১১ টাকা। তবে তার নিজের কোনও দামি পাথর বা সোনাদানা নেই। তবে তার স্ত্রীর ৩৬৮ গ্রাম সোনার গয়না রয়েছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ২৩ লক্ষ টাকা।
নির্বাচনী হলফনামায় আরও বলা হয়েছে, সায়নের ৬ লক্ষ ৬৬ হাজার ৭৮৫ টাকার দেনা রয়েছে। তার স্ত্রী সম্পর্কে হলফনামায় বলা হয়েছে, ৫ লাখ ৫৫ হাজার টাকা মূল্যের একটি গাড়ির মালিক তিনি। বাম আদর্শবিরোধী বুর্জোয়া দল বিজেপি, কংগ্রেস বা তৃণমূলের মতো সিপিএমের মতো শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিতেও এখন কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এটিকে নিঃসন্দেহে একটি বড় চমক বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।