X
বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২৫
১৯ চৈত্র ১৪৩১

পাকিস্তানের দিকে ‘গুগলি’ ছুড়ছে তালেবান?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:৪৪

পাকিস্তানের অসংখ্য সংকটের মধ্যে কোনটি শেষ পর্যন্ত দেশটিকে গ্রাস করবে তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। মুদ্রাস্ফীতি ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে, বেকারত্ব যুবকদের চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সামরিক বাহিনীর আনুগত্য বিভক্ত হয়ে পড়েছে রাষ্ট্র ও তাদের তৈরি করা সন্ত্রাসীদের মধ্যে এবং নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদরা পরস্পরকে ধ্বংসের লড়াইয়ে লিপ্ত। বাস্তবতা হলো পাকিস্তান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছে।

দেশটিকে প্রায়শই বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অক্টোবরে এই উপাখ্যানটি পুনরাবৃত্তি করেছিলেন, তখন কেবল স্পষ্টভাবে তিনি বিষয়টি উল্লেখ করছেন বলে মনে হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লক্ষ্য এক দশক আগে বিতাড়িত সন্ত্রাসীদের তাড়ানো। সরকার আগের ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ঋণের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। এদিকে দেশের রাজনীতিতে আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে দায়িত্বশীল হিসেবে দেখানো হচ্ছে। পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর, ঋণখেলাপি হওয়ার পথে এবং বন্ধু রাষ্ট্রগুলো দেশটিকে উদ্ধারে এগিয়ে আসবে- এমন আশাবাদও ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।

সাংবাদিক ও বিশ্লেষক আসাদ আলী তুর বলেছেন, পাকিস্তান এখন সবচেয়ে বড় যে সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে তা হলো বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট। জনগণ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ও দফতরের প্রতি আস্থা হারিয়েছে।

এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে দেশটির বিভক্ত রাজনৈতিক শ্রেণি একটি বিষয়ে একমত হতে পারে। আর তা হলো পাকিস্তানের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা জঙ্গি মোকাবিলার জন্য নীতির আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজন। তবে ঠিক কীভাবে এই মোকাবিলা তা নিয়ে ঐকমত্য নেই তাদের।

পাকিস্তানে প্রধান হুমকি তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। গোষ্ঠীটির সঙ্গে আল কায়েদা ও আফগান তালেবানের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে। আফগান তালেবান দেড় বছর আগে কাবুলের ক্ষমতায় ফিরেছে। টিটিপি আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে সক্রিয়। ২০২১ সালের আগস্টে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের সময় তাদের রেখে যাওয়া অস্ত্রে সজ্জিত গোষ্ঠীটি। ৩০ জানুয়ারি পেশোয়ারে একটি পুলিশ লাইন্সের মসজিদে তাদের আত্মঘাতী হামলায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য নিহত ও আহত হয়। টিটিপির পাশাপাশি রয়েছে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও। পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হামলা জোরদার করার চেষ্টা করছে তারা।

চরমপন্থার পুনরুত্থানের অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে সরকারের ব্যর্থতা। এই মাসের শুরুতে বিরোধীদের দাবির মুখে দেশব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি করা হবে বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটিতে যে সন্ত্রাসবাদের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এটি তার একটি স্বীকৃতি। কারণ আক্রমণ এবং হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সন্ত্রাসী হিসেবে নিষিদ্ধ সংগঠন এবং তালেবানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানির মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। নভেম্বর মাসে টিটিপি একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বাতিলের ঘোষণা দেয়।

পাকিস্তানে সামরিক পদক্ষেপের বিরোধিতার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ঐক্য নেই। উত্তর-পশ্চিমে আধিপত্য থাকা পশতুন প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো বলছে, স্থানীয়রা সামরিক অভিযানের ধকল সহ্য করেছে। যেমনটি ২০১৪ সালে সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানে হাজার হাজার লোককে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছিল। অন্যরা চায় যেকোনও নতুন অভিযান শুরু করার আগে অতীতের বেসামরিক ও সামরিক নেতাদের সেই অভিযানের পরিণতির জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। ইমরান খানের মতো ক্রিকেট তারকা থেকে অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানো নেতা বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ নির্বাচন বিলম্বিত করতে অভিযানের পথে হাঁটছে। নির্বাচনে তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) জিতবে। তাই সরকার চালাকি করছে।

লন্ডনের থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউজের পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী ফেলো ফারজানা শেখ বলেন, ‘কোনও ঐকমত্য নেই। সবাই বুঝতে পারছে যে জঙ্গি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই সমস্যাটি কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এমনকি গত সরকারের আগের সময়েও উদ্বেগ ছিল যে এই অভিযানে কোনও ইতিবাচক ফলাফল আসছে না। প্রচুর সহিংসতা হয়, এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি করে যাতে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো পুনরায় সামরিক শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ দেয়।’

পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি তর্কাতীতভাবে সেনাবাহিনীর নতুন প্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির। তিনি স্বীকার করেছেন টিটিপির সঙ্গে আলোচনার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তবে তিনি ২০১৪ সালের মতো বড় ধরনের অভিযানের পুনরাবৃত্তি করতে পারবেন না বলে মনে করেন সাংবাদিক আসাদ আলী তুর। তিনি বলেছেন, সম্প্রতি আদালতে জেনারেল মুনির ব্যাখ্যা দিয়েছেন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে নতুন কোনও সামরিক অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে না সেনাবাহিনী। তবে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গিদের আস্তানায় অভিযান অব্যাহত থাকবে। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান যে রূপেই নেওয়া হোক না কেন নীতিগত বড় পরিবর্তন না হলে সেনাবাহিনীর যেকোনও উদ্যোগকে জঙ্গিগোষ্ঠী ও উগ্র ডানপন্থি ধর্মীয় দলগুলোর প্রতি ঐতিহাসিক সমর্থন হিসেবে দেখা হবে।

সাধারণভাবে স্বীকৃত যে আফগানিস্তানকে নিয়ে পাকিস্তানের নীতি ব্যর্থ হয়েছে। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আফগানিস্তানকে ভারতের বিরোধিতায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন পাকিস্তান এমন জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে পড়েছে যেগুলোর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতা ছিল। একসময় তারা মনে করতো এগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

এসব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যেকোনও সামরিক পদক্ষেপ নেওয়াও কঠিন। সামরিক অভিযানের মধ্যে সীমান্তের উভয় পারে টিটিপির ঘাঁটিতে হামলা হবে। কিন্তু এতে কাবুলে তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে পাকিস্তানের উত্তেজনা বাড়বে, সীমান্ত অস্থিতিশীল হবে, আরও বেশি আফগানি পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেবে, এমনকি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করবে।

পরিহাসের বিষয় হলো, এই বছরের শেষের দিকে নির্বাচন হলে পিটিআই জিততে পারে বলে ইমরান খান দাবি করছেন। এই ইমরান খানই এই জঙ্গিবাদের কিছুটা বীজ বপন করেছিলেন বলে মনে করা হয়। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের প্রতি পিটিআই প্রধানের সমর্থনের কথা তুলে ধরে ফারজানা শেখ বলেছেন, জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি কিছুটা পক্ষপাত ছিল ইমরান খানের এবং জঙ্গিরা যে শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে তার একটি কারণ হলো পিটিআই সরকার তাদের সেই সুযোগ দিয়েছে। ফলে পিটিআই এবং সামরিক কাঠামোর কয়েকটি শাখাকে কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, এমন একটি ধারণা বিদ্যমান রয়েছে।

মধ্য-বাম ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্টের চেয়ারম্যান এবং পশতুন তাহাফুজ আন্দোলনের নেতা আইনপ্রণেতা মহসিন দাওয়ার বলছেন, একের পর এক সরকারের সংশয়যুক্ত বার্তা থেকে জনগণের আস্থার অভাব তৈরি হয়েছে। আফগানিস্তানের তালেবানের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীকে পররাষ্ট্রনীতির জন্য ‘ভালো’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে পাকিস্তানি তালেবানকে শত্রু হিসেবে বলা হয়েছে। অপর সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘খারাপ’, কারণ তারা আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকি। যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাপন্থিরা।

তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ না পাকিস্তানের আফগাননীতিতে পরিবর্তন আসছে ততদিন জনগণের পক্ষে সরকারের ওপর আস্থা রাখা কঠিন। আফগানিস্তানে কৌশলগত কারণে তালেবানকে সমর্থন দেওয়ার কথা বলে আসছি আমরা। এখন তারা আফগানিস্তান দখল করার পর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান এবং পুরো অঞ্চলে শান্তি একেবারে অসম্ভব।’

তার মতে সমাধান হলো, প্রথমত আফগান তালেবানের প্রতি সমর্থন বাদ দিতে হবে, পাকিস্তানে তাদের উপস্থিতি গুঁড়িয়ে দিতে হবে, পাকিস্তানের ভূখণ্ড থেকে তাদের একেবারে বিতাড়িত করতে হবে।

তার কথায়, কেবল তখনই নেতৃত্ব দেওয়া যাবে। আপনার যদি কিছু করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে সবসময় একটা না একটা উপায় থাকবেই।

ফরেন পলিসি অবলম্বনে।

 

/এএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ভয়াবহ ভূমিকম্পে কূটনৈতিক সুবিধা পেতে পারে মিয়ানমার জান্তা
গাজায় গণহত্যাআইসিসির পরোয়ানা উপেক্ষা করে হাঙ্গেরি সফরে নেতানিয়াহু
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জারদারি
সর্বশেষ খবর
দুর্ঘটনায় মারা গেছেন মা-বাবা, হাসপাতালে শিশু কন্যা
দুর্ঘটনায় মারা গেছেন মা-বাবা, হাসপাতালে শিশু কন্যা
চালককে গলা কেটে হত্যা করে ভ্যান নিয়ে পালানোর সময় একজনকে গণপিটুনি
চালককে গলা কেটে হত্যা করে ভ্যান নিয়ে পালানোর সময় একজনকে গণপিটুনি
রাজধানীর বনশ্রীতে নারী সাংবাদিককে হেনস্তা, রামপুরা থানায় মামলা
রাজধানীর বনশ্রীতে নারী সাংবাদিককে হেনস্তা, রামপুরা থানায় মামলা
শাহজালাল বিমানবন্দরে অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রা জব্দ 
শাহজালাল বিমানবন্দরে অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রা জব্দ 
সর্বাধিক পঠিত
সাবেক এমপি-মেয়রসহ আ.লীগের তিন নেতার বাসায় হামলা-ভাঙচুর
সাবেক এমপি-মেয়রসহ আ.লীগের তিন নেতার বাসায় হামলা-ভাঙচুর
আমরা কানেক্টিভিটি চাপিয়ে দেবো না, সেভেন সিস্টার্স প্রসঙ্গে হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ
আমরা কানেক্টিভিটি চাপিয়ে দেবো না, সেভেন সিস্টার্স প্রসঙ্গে হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ
গাজীপুর সাফারি পার্কে একদিনে ৮ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি
গাজীপুর সাফারি পার্কে একদিনে ৮ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি
তরমুজের বীজ খেলে এত উপকার পাওয়া যায় জানতেন?
তরমুজের বীজ খেলে এত উপকার পাওয়া যায় জানতেন?
লালমনিরহাটে ম্যুরাল ভাঙার প্রতিবাদে ডিসির অপসারণ চেয়ে সিপিবির মানববন্ধন
লালমনিরহাটে ম্যুরাল ভাঙার প্রতিবাদে ডিসির অপসারণ চেয়ে সিপিবির মানববন্ধন