প্রতিটি আইফোনেই লেখা থাকে—‘ডিজাইন্ড বাই অ্যাপল ইন ক্যালিফোর্নিয়া’। তবে এই প্রযুক্তিপণ্যের প্রকৃত জন্মস্থল হাজার মাইল দূরে, চীনে। অ্যাপলের আইফোন, আইপ্যাড কিংবা ম্যাকবুক—সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় চীনেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত ২৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কের টার্গেটও এখন চীন।
সারা বিশ্বে বছরে ২২ কোটির বেশি আইফোন বিক্রি করে অ্যাপল। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি তৈরি হয় চীনে। আইফোনের গ্লাস স্ক্রিন, ব্যাটারি, চিপ—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো সংগ্রহ, প্রস্তুত এবং সংযোজন হয় এখানেই। তারপর এগুলো যায় মার্কিন বাজারে—অ্যাপলের সবচেয়ে বড় ক্রেতার কাছে।
গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসন হঠাৎ করেই স্মার্টফোন, কম্পিউটারসহ কিছু ইলেকট্রনিক পণ্যে শুল্ক অব্যাহতি দেয়। আপাতত অ্যাপল স্বস্তি পেলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—‘কেউই ছাড় পাবে না’। একাধিক তদন্তে খতিয়ে দেখা হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের সম্পূর্ণ সাপ্লাই শৃঙ্খল।
এই সরবরাহ ব্যবস্থাটিই এত দিন অ্যাপলের শক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন সেটাই বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্পের শুল্কনীতি এক রাতেই পাল্টে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সামনে এনে দিয়েছে নতুন প্রশ্ন: কার কাকে বেশি প্রয়োজন?
৯০-এর দশকে যখন অ্যাপল প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছিল এবং দেউলিয়া হওয়ার পথে, তখনই চীনের উন্মুক্ত অর্থনীতি ছিল তাদের জন্য জীবনরক্ষাকারী। ২০০১ সালে সাংহাইয়ের এক ট্রেডিং কোম্পানির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনে প্রবেশ করে অ্যাপল। তারপর থেকে ফক্সকনের মতো চীনে কার্যরত তাইওয়ানিজ প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় শুরু হয় আইপড, আইম্যাক এবং পরে আইফোন তৈরির কাজ।
চীনকে তখন প্রস্তুত করতে হয়েছে আইফোনের জন্য। অ্যাপল নিজের মতো করে গড়ে তুলেছে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং সুপারস্টার’। উদাহরণ হিসেবে রয়েছে বেইজিং জিংদিয়াও—একটি অ্যাক্রিলিক কাটার প্রতিষ্ঠান, যা পরবর্তীতে অ্যাপলের সহায়তায় উচ্চগতির মেশিন টুল তৈরি করে গ্লাস কাটা শুরু করে।
২০০৮ সালে অলিম্পিকের বছর বেইজিংয়ে অ্যাপলের প্রথম স্টোর চালু হয়। এরপর ৫০টির বেশি শাখা ছড়িয়ে পড়ে চীনের নানা শহরে।
আজ অ্যাপলের আইফোনের অধিকাংশই উৎপাদন করে ফক্সকন। মূল চিপ আসে তাইওয়ানের টিএসএমসি থেকে। আর এসবের জন্য প্রয়োজনীয় দুর্লভ খনিজ মজুত রয়েছে চীনের হাতে। ২০২৪ সালের হিসাবে, অ্যাপলের ১৮৭ গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারীর মধ্যে ১৫০-এর কারখানা রয়েছে চীনে।
‘চীনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনও সরবরাহ ব্যবস্থা আমাদের নেই,’ বলেছিলেন অ্যাপল সিইও টিম কুক।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে অ্যাপল শুল্ক থেকে রেহাই পেয়েছিল। কিন্তু এবারে অ্যাপলকেই উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে ট্রাম্প প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক বলেন, ছোট ছোট স্ক্রু লাগানোর লাখ লাখ শ্রমিকদের কাজ এবার আমেরিকাতেই হবে।
হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিবও জানিয়েছেন—অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব আমেরিকায় উৎপাদন শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট।
তবে অনেকেই এই ভাবনাকে ‘কল্পনাপ্রসূত’ বলেই মনে করেন। অ্যাপলের সাবেক উপদেষ্টা ইলাই ফ্রিডম্যান বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকেই চীন থেকে সরবরাহ ব্যবস্থার বিকল্প নিয়ে ভাবছে অ্যাপল, তবে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই বিকল্প ছিল না।’ বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে ভিয়েতনাম ও ভারত—তবু চীনেই হচ্ছে বেশিরভাগ অ্যাসেম্বলি।
অ্যাপলকে কেন্দ্র করে চীনের হাজারো কারখানায় লাখ লাখ কর্মসংস্থান। এই শক্তি হারানো চীনের জন্য বড় আঘাত। তাই ট্রাম্পের হুমকিতে মাথা না নত করে, পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে চীন—মার্কিন পণ্যে ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক এবং রফতানিতে সীমাবদ্ধতা। দুর্লভ খনিজের নিয়ন্ত্রণও এখন কৌশলগত অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
তবে অ্যাপলের জন্য চীনই যে একমাত্র বিকল্প, সেটিও আর ঠিক নয়। অ্যাপলের এয়ারপডস ভিয়েতনামে তৈরি হচ্ছে—যদিও সেই দেশও ৪৬ শতাংশ শুল্কের মুখে।
ফ্রিডম্যান বলেন, ফক্সকনের মতো বিশাল কর্মীঘন কারখানার জন্য এখনও এশিয়ার দেশগুলোই একমাত্র বিকল্প, যাদের সবার ওপরই শুল্ক চাপছে।
এদিকে অ্যাপল এখন হুয়াওয়ে, ভিভোর মতো চীনা কোম্পানির কাছে বাজার হারাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দা, নিষিদ্ধ চ্যাটজিপিটির প্রভাবে চীনে অ্যাপলের এআই-নির্ভর প্রযুক্তির কদর কমছে। বিক্রি বাড়াতে জানুয়ারিতে অ্যাপল আইফোনে বিরল ছাড় দেয়।
চীনা সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অ্যাপলকে ব্লুটুথ, এয়ারড্রপের মতো প্রযুক্তিতে সীমাবদ্ধতা আনতে হয়েছে। তাই দিন দিন চীনে অ্যাপলের অবস্থান চাপের মুখে পড়ছে।
অ্যাপল যুক্তরাষ্ট্রে ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা ট্রাম্পকে কতটা খুশি করবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বারবার সিদ্ধান্ত বদলের মধ্যে দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতির ধারা অপ্রত্যাশিতভাবেই অ্যাপলের পরিকল্পনায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
পরামর্শক জিগার দীক্ষিত বলেন, স্মার্টফোনে শুল্ক দিলে অ্যাপল হয়তো ভেঙে পড়বে না। তবে রাজনৈতিক ও পরিচালনাগত চাপে পড়বে।
অ্যাপলের জন্য ঝুঁকি হয়তো কিছুটা কমেছে, তবে ফ্রিডম্যানের মতে—‘অ্যাপলের নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ নেই।’
সূত্র: বিবিসি