দুই বছরের গৃহযুদ্ধে সুদান এখন বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকটের মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তার মূল্য দিতে হচ্ছে দেশটির সাধারণ মানুষকে। যুদ্ধবিরতি আলোচনা পুনরায় শুরু করতে মঙ্গলবার লন্ডনে ২০টি দেশের মন্ত্রীদের নিয়ে এক বৈঠক করছে যুক্তরাজ্য। তবে ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধের মতো সংকটের কারণে সুদান সংকটে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা প্রায়ই উপেক্ষিত হচ্ছে।
খার্তুমে সুদানী সেনাবাহিনী ও প্যারামিলিটারি র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে সংঘর্ষ শুরুর দুই বছর পূর্তিতে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে আরএসএফের হামলায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই যুদ্ধের নৃশংসতা ও ব্যাপক মানবিক প্রভাব ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে আলোচিত।
সুদানের ৫১ মিলিয়ন মানুষের জন্য এর পরিণতি ভয়াবহ। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। লক্ষাধিক মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যার মধ্যে ৪০ লাখ প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়েছে।
অক্সফামের আঞ্চলিক অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার এলিস নালবান্ডিয়ান বলেন, সুদান এখন আগের চেয়েও খারাপ অবস্থায়। বৃহত্তম মানবিক সংকট, বৃহত্তম বাস্তুচ্যুতি সংকট, বৃহত্তম খাদ্য সংকট... এটি সব রেকর্ড ভঙ্গ করছে।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের সুদান মিশনের প্রধান ড্যানিয়েল ও’ম্যালি বলেন, এই সংঘাতে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ব্যাপক লঙ্ঘন হয়েছে। সুদানের সব বেসামরিক মানুষ যুদ্ধের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে আটকে পড়েছে। তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংখ্যাগুলো মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো।
গত মাসে সুদানী সেনাবাহিনী খার্তুমের অত্যন্ত প্রতীকী প্রেসিডেনশিয়াল প্রাসাদ পুনর্দখল করেছে এবং রাজধানীর বেশিরভাগ অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তবে দেশের বড় অংশে সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। আরএসএফ দারফুরে এল ফাশার দখলের চেষ্টা করছে, যা এই অঞ্চলের শেষ রাজ্য রাজধানী হিসেবে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।
গত সপ্তাহের শেষ থেকে আরএসএফ এল ফাশার ও এর কাছাকাছি জামজাম ও আবু শুক শরণার্থী শিবিরে স্থল ও বিমান হামলা চালিয়েছে। জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র এএফপিকে বলেছেন, তারা ১৪৮টি হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত করেছে এবং বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেছে, নিহতের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়েছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু জামজাম শিবির থেকে গত কয়েক দিনে ৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টুর্ক বলেন, বৃহৎ আকারের এই হামলা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তার মূল্য স্পষ্ট করে দিয়েছে, যদিও আমি বারবার সতর্ক করেছি যে এই অঞ্চলের বেসামরিক মানুষের ঝুঁকি বেড়েছে।
এল ফাশার দারফুরের এমন কিছু অঞ্চলের মধ্যে একটি, যেখানে ৬ লাখ ৩৭ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে। সুদানের ৫ কোটি মানুষের প্রায় অর্ধেক—২ কোটি ৪৬ লাখ—খাদ্য সংকটে ভুগছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সুদান বিষয়ক যোগাযোগ প্রধান লেনি কিন্জলি বলেন, অন্যান্য সংঘাত, সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের অভাব এবং সাবেক স্বৈরশাসক ওমর আল-বশিরের আমল থেকে সুদানের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার কারণে এই সংকট প্রয়োজনীয় মনোযোগ পাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা সুদানের জন্য অন্যান্য সংকটের মতো আন্তর্জাতিক মনোযোগ দেখছি না। সংকটের মধ্যে প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বজুড়ে অন্যান্য সংঘাত ও মানবিক সংকট শিরোনামে থাকায় সুদানকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।
এই যুদ্ধের সূত্রপাত ২০১৮ সালের শেষের দিকে, যখন সুদানের স্বৈরশাসক বশিরের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ২০১৯ সালের এপ্রিলে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান ও আরএসএফ প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো (হেমেদতি) একত্রে বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ২০২১ সালে তারা একটি বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এই বেসামরিক সরকারের লক্ষ্য ছিল সুদানকে গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়া। তবে হেমেদতি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করছিলেন এবং দুই নেতার মধ্যে উত্তেজনা দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়।
আরএসএফ, যা ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি দারফুরে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া থেকে গঠিত হয়েছিল, যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহ ও মাসগুলোতে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করে। দারফুরে যুদ্ধের প্রথম বছরে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়, আরএসএফ ও তাদের মিত্র মিলিশিয়াদের দ্বারা অ-আরব মাসালিত ও অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীর ওপর হামলায়। মাসালিত শরণার্থীরা শাদে পালিয়ে যাওয়ার পর নারী ও মেয়েদের সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও রাস্তায় ছেলেদের গুলি করার কথা জানিয়েছে। জাতিসংঘের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, মিলিশিয়া যোদ্ধারা বলেছে তারা নারীদের ‘আরব বাচ্চা’ জন্ম দিতে বাধ্য করবে।
আরএসএফ ও সেনাবাহিনী উভয়ই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের মুখে রয়েছে। গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে যে আরএসএফ গণহত্যা চালিয়েছে, যা সুদানে গত ৩০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় গণহত্যা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহ করে যুদ্ধে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। গত বছর যুদ্ধক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাসপোর্ট পাওয়া গেছে, যা সেখানে তাদের গোপন সামরিক উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। তবে আমিরাত যুদ্ধে কোনও ভূমিকা নেই বলে দাবি করেছে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান